দেশে অধিকাংশ মেডিকেল কলেজের নিজস্ব হাসপাতাল নেই

দেশে মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে এবং শিক্ষা কার্যক্রম চালু করতে গুরুত্বপূর্ণ অনেক শর্ত মানতে হয়। তবে তা সিংহভাগই মানা হচ্ছে না। ৫০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে একটি মেডিকেল কলেজ চালু করতে হলে তার সঙ্গে ২৫০ শয্যার একটি হাসপাতাল থাকার বাধ্যবাধ্যকতা রয়েছে।

- Advertisement -

শিক্ষার্থী ১০০ হলে হাসপাতাল হতে হবে ৫০০ শয্যার। অর্থাৎ একজন শিক্ষার্থীর জন্য রোগী শয্যা হবে পাঁচটি। এ ক্ষেত্রে বলা আছে, হাসপাতালে ৭০ শতাংশ শয্যায় সব সময় রোগী থাকতে হবে।

- Advertisement -google news follower

এই গুরুত্বপূর্ণ শর্তটি হাসপাতালে মানা হচ্ছে না। স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, অধিকাংশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৭০ শতাংশ শয্যা রোগীতে পূর্ণ থাকে না। এমন হাসপাতালে আছে, যাদের রোগী থাকে মাত্র ১০ শতাংশ।

এদিকে বিএমডিসির নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, প্রতিটি মেডিকেল কলেজের অবশ্যই নিজস্ব হাসপাতাল থাকতে হবে। এক্ষেত্রে কলেজের সঙ্গে একই জমিতে ভিন্ন ভবনে হাসপাতাল স্থাপন করতে হবে। এছাড়া হাসপাতালের শয্যা সংখ্যাসহ কলেজে কোন বিভাগের কতজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী থাকবে তা-ও নির্দেশিকায় উল্লেখ করা রয়েছে।

- Advertisement -islamibank

জানা গেছে, সারাদেশে সরকারি মেডিকেল কলেজ রয়েছে ৩৭টি। আর বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ৭৩টি। এর মধ্যে শর্ত পূরণ না করায় কয়েকটি মেডিকেল কলেজের নিবন্ধন স্থগিত রেখেছে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়।

প্রতিটি মেডিকেল কলেজের সঙ্গে সব ধরনের বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা সংবলিত নিজস্ব একটি হাসপাতাল থাকার কথা থাকলেও দেশের ৩৭ টি সরকারি মেডিকেল কলেজের ১৮ টির-ই কোন নিজস্ব হাসপাতাল নেই। আর বেসরকারি পর্যায়ে প্রায় ৬০ শতাংশ মেডিকেল কলেজের নিজস্ব হাসপাতাল নেই।

প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম শিক্ষক সংখ্যা। নিজস্ব শ্রেণীকক্ষ না থাকায় অন্য প্রতিষ্ঠানের বারান্দায় ধারে চলে পাঠদান। হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ নিতে পারবে, মেডিকেল কলেজের কাছে এমন কোনো হাসপাতাল না থাকায় মেডিকেল কলেজের শত শত শিক্ষার্থী তাদের একাডেমিক পাঠকে ব্যবহারিক স্বাস্থ্যসেবার সাথে যুক্ত করতে ব্যর্থ হচ্ছে।

কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কলেজ ক্যাম্পাস নেই। নেই ছাত্রাবাস ও ইন্টার্ন চিকিৎসকদের জন্য হোস্টেল সুবিধা। বেশ কয়েকটি কলেজের শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নি করতে ছুটতে হয় প্রায় ছয় কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট সদর হাসপাতালে।

স্থানীয় জেলা ও জেনারেল হাসপাতালগুলোয় প্রশিক্ষণ নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম শেষ করছেন নবীন চিকিৎসকরা। এসব কারণে ১৮টি সরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের দক্ষ চিকিৎসক হয়ে ওঠাই চ্যালেঞ্জ মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে, দেশে সরকারি মেডিকেল কলেজ রয়েছে ৩৭টি। এসব মেডিকেল কলেজের মধ্যে নিজস্ব হাসপাতাল রয়েছে ১৯টির। এর মধ্যে পূর্ণরূপে চালু রয়েছে ১৮টি।

সম্প্রতি পটুয়াখালী জেনারেল হাসপাতালকে পাঁচশ শয্যায় উন্নীত করে স্থানীয় মেডিকেল কলেজের সঙ্গে সংযুক্ত করে গেজেট প্রকাশিত হয়েছে। যদিও এর আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম এখনো শুরু করা যায়নি।

বাকি ১৮টির শিক্ষার্থীরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন স্থানীয় জেলা ও জেনারেল হাসপাতালে। এর মধ্যে ছয়টির জন্য বর্তমানে হাসপাতাল নির্মাণাধীন রয়েছে। অন্য ১২টির কোনো কোনোটিতে এখনো এ-সংক্রান্ত কোনো প্রকল্প চূড়ান্ত হয়নি।

বর্তমানে ছয়টি সরকারি মেডিকেল কলেজের হাসপাতাল নির্মাণাধীন রয়েছে। এগুলোর মধ্যে মানিকগঞ্জের কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজ, কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ, গোপালগঞ্জে শেখ সায়েরা খাতুন মেডিকেল কলেজ, টাঙ্গাইলে শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ ও সিরাজগঞ্জে শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের নির্মাণাধীন হাসপাতালের বহির্বিভাগ এরই মধ্যে চালু হয়েছে।

তবে এখন পর্যন্ত অবকাঠামো নির্মাণ শেষ না হওয়ায় কোনো রোগী ভর্তি করা যায়নি। হাসপাতাল নির্মাণাধীন রয়েছে এমন আরেকটি মেডিকেল কলেজ হলো সুনামগঞ্জে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ। সম্প্রতি কার্যক্রম শুরু করা মেডিকেল কলেজটির শিক্ষা কার্যক্রম চলছে জেলার শান্তিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, যেগুলোর ক্যাম্পাস ও হাসপাতাল কিছুই নেই। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্র্থীরা অস্থায়ী ক্যাম্পাসে গিয়ে লেখাপড়া এবং অন্য হাসপাতালে ক্লিনিক্যাল পাঠ নিচ্ছেন।

যেসব সরকারি মেডিকেল কলেজে নিজস্ব হাসপাতাল নেই সেগুলো হলো, সরকারি পাবনা মেডিকেল কলেজ, আব্দুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজ (নোয়াখালী), কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ, যশোর মেডিকেল কলেজ, শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ (জামালপুর), রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ, শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ (হবিগঞ্জ), নেত্রকোনা মেডিকেল কলেজ, নীলফামারী মেডিকেল কলেজ, নওগাঁ মেডিকেল কলেজ, মাগুরা মেডিকেল কলেজ ও চাঁদপুর মেডিকেল কলেজ।

সরকারি মেডিকেল কলেজ সম্পর্কে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানা গেছে, দেশে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে প্রতি শিক্ষাবর্ষে ৪ হাজার ৩৫০ জন করে শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছেন।

এ হিসাবে কলেজগুলোয় ৫ বছরের একাডেমিক (প্রাতিষ্ঠানিক) শিক্ষাজীবনে ২১ হাজার ৭৫০ জন লেখাপড়া করছেন। তাদের মধ্যে যারা ওই ১৮টি কলেজের শিক্ষার্থী, তারা নানা সমস্যার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছেন।

তারা স্বাস্থ্য শিক্ষার মতো মৌলিক বিষয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের চেয়ে যোগ্যতা অর্জনে পিছিয়ে পড়ছেন। তারা ভবিষ্যতে জনগণকে কী সেবা দেবেন, তা নিয়ে শঙ্কিত সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক সম্প্রতি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, চিকিৎসা পেশা অন্যান্য পেশার মতো নয়। এর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ একই মানের হতে হবে।

মানুষের সুস্থতার প্রশ্নে প্রয়োজনীয় সেবা একজন উপযুক্ত প্রশিক্ষিত চিকিৎসকের কাছে পাওয়া যাবে। যেসব কলেজের হাসপাতাল নেই, সেসব কলেজের শিক্ষার্থীরা জেলা বা জেনারেল হাসপাতালের ওপর নির্ভরশীল। এসব শিক্ষার্থীর প্রশিক্ষণ পরিপূর্ণতা পাচ্ছে না। কারণ জেলা বা জেনারেল হাসপাতালে খুবই সাধারণ চিকিৎসা হয়।

দেশের চিকিৎসকদের শিক্ষার ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য রাখা যাবে না। দেশের প্রথম দিককার একটি কলেজ থেকে যে শিক্ষার্থী চিকিৎসক হয়ে বের হচ্ছেন, তার সঙ্গে নতুন কলেজের চিকিৎসকের বড় রকমের পার্থক্য দেখা যায়। এটি ঘটছে মূলত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের কারণে।

সার্বিক চিকিৎসাসেবায়ই এর বিরূপ প্রভাব রয়েছে। এজন্য খাতসংশ্লিষ্টরা যা কিছুই বলুক না কেন, জেনারেল হাসপাতালে যে প্র্যাকটিস হচ্ছে তাতে অপূর্ণতা থাকবেই।

যেসব প্রতিষ্ঠানের হাসপাতাল নেই, সেখানে সাময়িক সময়ের জন্য জেলা সদরের হাসপাতাল ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগের সচিব ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার।

তবে সব মেডিকেলেরই নিজস্ব হাসপাতাল হবে। চারটা মেডিকেলের বিষয়ে ভারতের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছিল। এখন নিজেরাই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। রাজস্ব বাজেট থেকে এসব হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হবে।

এদিকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ স্থাপন ও পরিচালন নীতিমালায় বলা হয়েছে, কলেজ ভবন ও হাসপাতাল একই জায়গায় পৃথক ভবনে হতে হবে। কিন্তু অধিকাংশ মেডিকেল কলেজে তা নেই।

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ৬২ শতাংশ বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ওই পরিমাণ জায়গা নেই। অবশ্য ৮ শতাংশ প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে কোনো তথ্য অধিদপ্তরে জমা দেয়নি।

এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগের সচিব ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, হাসপাতাল ছাড়া মেডিকেল কলেজ চালানো যায় না।

জেএন/পিআর

KSRM
পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জয়নিউজবিডি.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন news@joynewsbd.com ঠিকানায়।

এই বিভাগের আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ

×KSRM