ভোর উপর দিয়েই মঙ্গলবার রাতেই ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং বাংলাদেশের উপকূল অতিক্রম করে ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছে। একই সময়ে আঘাত হেনেছে বিভিন্ন উপজেলার উপকুলে।
এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সিত্রাংয়ের আঘাতে দেশের ৭ জেলায় ১১ জন মারা গেছেন। ঝড়ের প্রভাবে চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগের বেশির ভাগ জায়গায় ঝড়ো বাতাস ও ভারী বৃষ্টি হয়েছে।
সমুদ্র উপকূলের ১৫টি জেলার নদ–নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ৩ থেকে ৫ ফুট উচ্চতা নিয়ে বয়ে গেছে। মারা যাওয়াদের মধ্যে এর মধ্যে কুমিল্লায় একই পরিবারের তিন জন, ভোলায় দুজন, সিরাজগঞ্জে দুজন, নড়াইল, বরগুনা, শরীয়তপুর ও রাজধানী ঢাকায় একজন করে রয়েছেন।
কুমিল্লা : ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলার হেশাখালে গাছ উপড়ে একই পরিবারের ৩ জন নিহত হয়েছেন। সোমবার (২৪ অক্টোবর) রাত ৯ টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন হেশাখাল ইউনিনিয়নের চেয়ারম্যান ইকবাল বাহার মজুমদার।
নিহতরা হলেন, ওই এলাকার নিজাম উদ্দিন, তার স্ত্রী সাথি আক্তার ও কন্যাশিশু লিজা। এ ব্যাপারে চেয়ারম্যান ইকবাল বাহার মজুমদার বলেন, এখনও ঝড়ের তাণ্ডব চলছে, তাই ঘটনাস্থলে যেতে পারছি না। শুনেছি ঘরে একজন ও হাসপাতালে নেওয়ার পর দুজন মারা গেছে।
নাঙ্গলকোট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রায়হান মেহবুব বলেন, রাত সাড়ে ১১টার দিকে খবর পেয়েছি, গাছ পড়ে তিন জনের মৃত্যু হয়েছে। ঘটনাস্থলে উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ আছে। উদ্ধার কার্যক্রম চলছে।
নাঙ্গলকোট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফারুক হোসেন বলেন, তিন জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ঘরের ওপর পড়া গাছটি সরানোর চেষ্টা করছি আমরা। সেখানে আরও কেউ চাপা পড়েছে কিনা তা দেখছি।
নড়াইল : ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে নড়াইলের লোহাগড়ায় ভারী বর্ষণ ও ঝোড়ো বাতাসে গাছের ডাল ভেঙে পড়ে মর্জিনা বেগম (৪০) নামে এক গৃহকর্মীর মৃত্যু হয়েছে।
সোমবার (২৪ অক্টোবর) দুপুরে উপজেলা পরিষদ চত্বরের পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের অদূরে এ ঘটনা ঘটে। মর্জিনা বেগম বাগেরহাট সদর উপজেলার অর্জুন বাহার গ্রামের মৃত এয়াকুব আলী শেখের মেয়ে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মর্জিনা বেগম লোহাগড়া পৌরসভার রাজোপুর গ্রামের গফফার শেখের বাড়ির ভাড়াটিয়া ছিলেন।
তার মাদ্রাসাপড়ুয়া ছেলে জিহাদকে (৮) নিয়ে ভাড়া বাড়িতে থেকে অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করতেন। বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে ভাড়া বাসা থেকে কাজের উদ্দেশে তিনি বের হন।
লোহাগড়া উপজেলা পরিষদ চত্বরের পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের অদূরে পৌঁছালে ঝোড়ো বাতাসে মেহগনি গাছের ডাল ভেঙে তার মাথায় পড়ে। এতে তিনি গুরুতর আহত হন। স্থানীয়রা মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে লোহাগড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
লোহাগড়া থানার ওসি মো. নাসির উদ্দিন বলেন, খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে লাশ পান। এরপর স্বজনদের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে।
লোহাগড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আজগর আলী বলেন, বিষয়টি তাৎক্ষণিক জেলা প্রশাসককে জানানো হয়। নিহতের একমাত্র সন্তান স্থানীয় মাদ্রাসা ও এতিমখানার শিক্ষার্থী। দ্রুত জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে সরকারিভাবে আর্থিক অনুদানসহ সার্বিক সহযোগিতা করা হবে।
ভোলা : ভোলায় ঝোড়ো বাতাসে গাছ চাপা পড়ে দুই জনের মৃত্যু হয়েছে। সোমবার (২৪ অক্টোবর) সন্ধ্যায় চরফ্যাশন ও দৌলতখান উপজেলায় এ ঘটনা ঘটে।
মৃতরা হলেন- দৌলতখান পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের গোলাম মোস্তফার স্ত্রী বিবি খাদিজা (৮০) ও চরফ্যাশন উপজেলার শশীভূষণ ইউনিয়নের মনির হোসেন (৩০)।
দৌলতখান উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলম খান বলেন, সন্ধ্যায় নিজ ঘরে অবস্থান করেছিলেন বিবি খাদিজা। ঝড়ো বাতাসে হঠাৎ একটা বড় গাছ এসে ঘরের চালে পড়ে।
এতে চাপা পড়ে খাদিজা আহত হন। স্বজনরা তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।
চরফ্যাশন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আল নোমান বলেন, মোটরসাইকেলে বাড়ি ফিরছিলেন মনির। এ সময় বাতাসে একটি গাছের ডাল ভেঙে গায়ে পড়লে আহত হন। তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে তার মৃত্যু হয়।
বরগুনা : ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে ঝোড়ো হাওয়ায় বরগুনায় ঘরের ওপর গাছ পড়ে এক বৃদ্ধার মৃত্যু হয়েছে। সোমবার রাত ৮টার দিকে এই ঘটনা ঘটে। নিহত নারীর নাম আমেনা খাতুন। তার বয়স ১১৫ বছর।
তিনি বরগুনা সদর উপজেলার সোনাখালি গ্রামের বাসিন্দা। তার পরিবারকে আর্থিক সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে জেলা প্রশাসন।
শরীয়তপুর : ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে ঝোড়ো হাওয়ায় বসতঘরের ওপর গাছ পড়ে শরীয়তপুরের জাজিরায় সাফিয়া খাতুন (৬৫) নামে এক নারী মারা গেছেন। সোমবার সন্ধ্যার দিকে এ ঘটনা ঘটে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. কামরুল হাসান সোহেল।
সিরাজগঞ্জে মা-ছেলের মৃত্যু : সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার সয়দাবাদ ইউনিয়নের পূর্বমোহন ও শিল্পপার্কের মাঝখানে যমুনা নদীর ক্যানেলে সিত্রাংয়ের প্রভাবে নৌকা ডুবে মা ও ছেলের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে।
পূর্বমোহনপুর বাড়ি যাওয়ার পথে সোমবার (২৪ অক্টোবর) রাত নয়টার দিকে এ নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন, পূর্বমোহনপুর গ্রামের খোকনের স্ত্রী আয়েশা খাতুন (২৮) ও তার ছেলে আরাফাত হোসেন (২)।
এছাড়া রাজধানী ঢাকায় ঝড়ের কবলে পড়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, ১৫ জেলায় ক্ষতির আশঙ্কা বেশি। জেলাগুলো হলো কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা, ঝালকাঠি, ভোলা, পটুয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী ও বরিশাল।
সিত্রাংয়ের প্রভাবে দেশের বরিশাল, চট্টগ্রাম উপকূলসহ সারা দেশে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। সোমবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত শুধু বরিশালে ৩৫২ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। যা এ মৌসুমের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত। এ ছাড়া পটুয়াখালীতে ২৯৪, মোংলায় ২১৯ ও খুলনায় ১৮৭ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে।
জেএন/পিআর