গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেল এবং সারের সরবরাহ ও বিপণন ব্যবস্থাপনা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করে সরকার। মূল্যস্টম্ফীতি ও জনসাধারণের ওপর বিরূপ প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে পণ্য ও সেবার দাম নির্ধারণ করা হয়। ভোক্তা পর্যায়ে মূল্য সহনশীল রাখতে দীর্ঘদিন ধরেই এসব খাতে ভর্তুকি দিয়ে আসছে সরকার। আন্তর্জাতিক বাজারে এগুলোর দাম বাড়লে দেশেও তার প্রভাব পড়ে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাস ও জ্বালানি তেলের ঊর্ধ্বগতির কারণে ভর্তুকির পরিমাণও বেড়ে যাচ্ছে। ফলে চাপের মধ্যে দেশের সার্বিক অর্থনীতি। এতে করে সংকটে পড়েছে বাজেট ব্যবস্থাপনা। সামগ্রিক বিষয় বিবেচনায় জ্বালানি তেলের পর এবার গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকির চাপ কমানোর প্রস্তাব করেছে অর্থ বিভাগ।
গতকাল মঙ্গলবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে আর্থিক, মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার-সংক্রান্ত সমন্বয় কাউন্সিলের বৈঠকে এ সুপারিশ করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এ বিভাগটি। বৈঠকে কৃষিমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী ছাড়াও অর্থ, বাণিজ্য, কৃষি ও পরিকল্পনা সচিব এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন।
এতে আমদানি-রপ্তানি, রাজস্ব আদায়, মূল্যস্টম্ফীতি, রেমিট্যান্সসহ বিভিন্ন সূচকের হালনাগাদ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়। এ বৈঠকের পর বাজেট ব্যবস্থাপনা ও সম্পদ কমিটির বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়। এতে চলতি অর্থবছরের অর্থনৈতিক ও বাজেট বাস্তবায়নের নানা দিক ও আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট প্রাক্কলন নিয়ে আলোচনা হয়।
অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এমন সময় বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হলো, যখন আইএমএফ থেকে ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণ পাওয়ার বিষয়ে আলোচনা চলছে। এ ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আইএমএফের অন্যতম শর্ত হচ্ছে, ভর্তুকি কমিয়ে আনতে হবে। বর্তমানে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক (ইডি) ড. কৃষ্ণমুর্তি ভি সুব্রামানিয়ান বাংলাদেশে রয়েছেন। আগামী মাসে আসবেন আইএমএফের ডিএমডি অ্যান্তইনেত সায়েহ।
অর্থ বিভাগের পক্ষে সিনিয়র সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন সমন্বয় কাউন্সিলকে জানান, ডলার সংকটের কারণে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। খাদ্যপণ্য ও জ্বালানির দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ায় মূল্যস্টম্ফীতির চাপ বেড়েছে। ভর্তুকি বাড়িয়েও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া রপ্তানি ও রেমিট্যান্স না বাড়ায় আমদানি ব্যয়ের সঙ্গে তাল মেলানো যাচ্ছে না। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। সংকট মোকাবিলা করতে গিয়ে বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। বৈঠকে বৈধ পথে রেমিট্যান্স বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে আরও উদ্যোগ নেবে বলে জানানো হয়। এ ছাড়া রপ্তানি আরও বাড়াতে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। গতকালের বৈঠকে উপস্থিত একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
এ বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, আমরা কোনো সংকটকেই সংকট হিসেবে দেখছি না। এগুলো আমাদের জন্য একেকটি চ্যালেঞ্জ। চলমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে অনেক দেশই সংকটে রয়েছে। বৈশ্বিক পরিস্থিতি আমরা এড়াতে পারি না। সামনের বছর পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হবে।
তিনি আরও বলেন, আইএমএফের ঋণের প্রথম কিস্তি ফেব্রুয়ারিতে পাওয়ার কথা। অন্য উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গেও ঋণের বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। আগামী বছর উলেল্গখযোগ্য অর্থ পাওয়া যাবে, যা দেশের অর্থনীতিতে এক ইতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে। মূল্যস্ম্ফীতিও কমে আসবে।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাবদ বরাদ্দ রয়েছে ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিদ্যুতের জন্য ১৭ হাজার কোটি টাকা এবং এলএনজির জন্য ১৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। তবে এসব খাতে যে পরিমাণ বরাদ্দের চাহিদা আসছে, তাতে আরও অর্থের প্রয়োজন হবে। তাই আপাতত বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি চাপ কমানো প্রয়োজন বলে মনে করছে অর্থ বিভাগ।
গত রোববার আওয়ামী লীগের এক আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, সবাইকে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং গ্যাস কেনার প্রকৃত ব্যয় পরিশোধের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। বিশ্ব অর্থনীতির সংকটের এ সময় ভর্তুকি দেওয়া সরকারের পক্ষে সম্ভব হবে না। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের হিসাবে ভর্তুকি প্রত্যাহার করা হলে বিদ্যুতে প্রায় ৩৪ শতাংশ ও গ্যাসের দাম বাড়বে প্রায় ৩১ শতাংশ।
আগামী বাজেট হবে সাড়ে ৭ লাখ কোটি টাকার :বৈঠকে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে সাড়ে ৬ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৭ শতাংশ প্রাক্কলন করে ৭ লাখ ৫০ হাজার ১৯৪ কোটি টাকার সম্ভাব্য বাজেটের রূপরেখা উপস্থাপন করা হয়। রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৪ লাখ ৮৬ হাজার কোটি টাকা। এদিকে, চলতি অর্থবছরের ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট থেকে কমিয়ে সংশোধিত বাজেট ৬ লাখ ৫৭ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা করা হচ্ছে। এ ছাড়া মূল্যস্টম্ফীতি প্রাক্কলন ৫ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৬ শতাংশ করা হচ্ছে।
জেএন/এমআর