আজ ২৪ মার্চ বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস। ১৮৮২ সালের এ দিনে ড. রবার্ট কোচ যক্ষ্মার জীবাণু আবিষ্কার ও এ রোগ নির্ণয় ও নিরাময়ের পথ উন্মোচন করেন। তাকে স্মরণ করেই দিনটিতে যক্ষ্মা দিবস পালিত হয়ে থাকে।
যক্ষ্মা রোগের ক্ষতিকর দিক বিশেষ করে স্বাস্থ্য, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিণতি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে প্রতি বছর এ দিবসটি পালিত হয়ে থাকে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, প্রতিদিন বিশ্বে চার হাজার মানুষ যক্ষ্মা রোগে মারা যায় এবং ৩০ হাজার আক্রান্ত হয়। তবে বৈশ্বিক প্রচেষ্টায় ২০০০ সাল থেকে ৫৮ মিলিয়ন মানুষের জীবন রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে।
জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির (এনটিপি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে এনটিপির মাধ্যমে দেশে ২ লাখ ৬৭ হাজার ২৭৬ জন যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি সরকারিভাবে তাদের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
এদের মধ্যে ১৫ বছরের কম বয়সী শিশু যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত হয়েছে ১১ হাজার ৩৫২ জন। বর্তমানে দেশে ২০০টি জিন এক্সপার্টের মাধ্যমে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম চলছে এবং অতিরিক্ত আরও ৭৬টি জিন এক্সপার্ট মেশিন সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
দিবসটি উপলক্ষে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি ও বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে, প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ ও প্রচার, জেলা শহর ও সিটি করপোরেশন এলাকায় আলোচনা সভা, শোভাযাত্রা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের যে ৩০টি দেশে যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
সরকারের জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির দেওয়া তথ্য বলছে, ২০২১ সালে যক্ষ্মার উপসর্গ আছে এমন প্রায় ২৮ লাখের বেশি মানুষের পরীক্ষা করা হয়েছে। এ সময় ৩ লাখ ৭ হাজার ৪৪৪ জন নতুন যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত হয়েছে। এ হিসেবে দৈনিক ৮৪২ জনের বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে।
এর মধ্যে বরিশাল বিভাগে ২১ হাজার ৪৮১ জন, চট্টগ্রামে ৬০ হাজার ২২ জন, ঢাকায় ৮০ হাজার ১৩৭ জন, খুলনায় ৩৯ হাজার ৭৯৬ জন, ময়মনসিংহে ১৯ হাজার ৪৭ জন, রাজশাহীতে ২৯ হাজার ৩৩৫ জন, রংপুরে ৩১ হাজার ৭০৮ জন ও সিলেটে ২৫ হাজার ৯১৮ জন যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত হয়েছে। তবে যক্ষ্মা থেকে সুস্থতার হার ৯৫ দশমিক ২৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিদিন রোগটিতে ১০৭ জনের মৃত্যু হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি পরিসংখ্যান বলছে এই সংখ্যা দিনে ১৮৫।
বিশ্বব্যাপী যক্ষ্মা নির্মূলে গবেষণার পথিকৃৎ প্রতিষ্ঠান ডেমিয়েন ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ ডা. মাহফুজা রিফাত বলেন, বর্তমানে যক্ষ্মারোগের চিকিৎসার জন্য অনেক ভালো মানের ওষুধ রয়েছে যা সরকারি ও সহযোগী সংস্থার মাধ্যমে রোগীদের জন্য সম্পূর্ণ বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়। যক্ষ্মার উন্নত চিকিৎসা এখন দেশেই পাওয়া যাচ্ছে। যক্ষ্মা প্রতিরোধে বিসিজি টিকা দেওয়া হয়।
রোগের লক্ষণ ও উপসর্গ
ফুসফুসে যক্ষ্মা হলে হাল্কা জ্বর ও কাশি হতে পারে। কাশির সঙ্গে গলার ভেতর থেকে থুতুর সঙ্গে রক্তও বেরোতে পারে। মুখ না ঢেকে কাশলে যক্ষ্মা সংক্রমণিত থুতুর ফোঁটা বাতাসে ছড়ায়। আলো-বাতাসহীন অস্বাস্থ্যকর বদ্ধ পরিবেশে মাইকোব্যাক্টেরিয়াম অনেকক্ষণ বেঁচে থাকে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট হিসেবে ৫-৬ মাস জ্বর থাকার মূল কারণ এই টিবি।
সাধারণত তিন সপ্তাহের বেশি কাশি থাকা, জ্বর, কাশির সঙ্গে কফ এবং মাঝে মাঝে রক্ত বের হওয়া, ওজন কমে যাওয়া, বুকে ব্যথা হওয়া, দুর্বলতা ও ক্ষুধামন্দা ইত্যাদি ফুসফুসের যক্ষ্মার প্রধান উপসর্গ।
যক্ষ্মা ফুসফুস থেকে অন্যান্য অঙ্গেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। বিশেষ করে, যাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল তাদের এবং বাচ্চাদের ক্ষেত্রে। তখন একে ‘অ-শ্বাসতন্ত্রীয় যক্ষ্মা’ (Extrapulmonary Tuberculosis) বলা হয়।
যেমন প্লুরাতে প্লুরিসি, কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে মেনিনজাইটিস, লসিকাতন্ত্রে স্ক্রফুলা, প্রজনন তন্ত্রে প্রজনন তন্ত্রীয় যক্ষ্মা, পরিপাক তন্ত্রে পরিপাক তন্ত্রীয় যক্ষ্মা এবং অস্থিকলায় পটস ডিজিস। বিশেষ ধরনের ছড়িয়ে যাওয়া যক্ষ্মাকে বলা হয় মিলিয়ারী যক্ষ্মা (Miliary tuberculosis)।
অনেক ক্ষেত্রে ফুসফুসীয় এবং অ-ফুসফুসীয় যক্ষ্মা একসঙ্গে বিদ্যমান থাকতে পারে। পৃথিবীর যক্ষ্মা রোগীদের এক তৃতীয়াংশেরও বেশি (প্রায় অর্ধেক) ভারতীয় উপমহাদেশবাসী। জীবাণু শরীরে ঢুকলেই সবার যক্ষ্মা হয় না। যাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাদের ক্ষেত্রে যক্ষ্মা বেশি হয়।
যক্ষ্মা কীভাবে ছড়ায়?
বাতাসের মাধ্যমে যক্ষ্মা রোগের জীবাণু ছড়ায়। যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি বা কাশির মাধ্যমে রোগের জীবাণু বাতাসে গিয়ে মেশে এবং রোগের সংক্রমণ ঘটায়।
যক্ষ্মা প্রতিরোধ করার উপায়
জন্মের পর পর প্রত্যেক শিশুকে বিসিজি টিকা দেয়া, হাঁচি-কাশি দেয়ার সময় রুমাল ব্যবহার করা, যেখানে সেখানে থুথু না ফেলা এবং রোগীর কফ থুথু নির্দিষ্ট পাত্রে ফেলে তা মাটিতে পুঁতে ফেলা।
যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসা
যখন কোনো এন্টিবায়োটিক যক্ষ্মা রোগের সব জীবাণু ধ্বংস করতে ব্যর্থ হয়, তখনই ওষুধ প্রতিরোধক যক্ষ্মার সূত্রপাত হয়। ওষুধ প্রতিরোধক যক্ষ্মার মূল কারণগুলো হলো- পর্যাপ্ত চিকিৎসা গ্রহণ না করা, ভুল ওষুধ সেবন এবং চিকিৎসার কোর্স সম্পূর্ণ না করা।
কখন ডাক্তার দেখাবেন?
যক্ষ্মার লক্ষণ ও উপসর্গ দেখা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।
কোথায় চিকিৎসা করাবেন
বাংলাদেশের সব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা সদর হাসপাতাল, বক্ষব্যাধি ক্লিনিক/হাসপাতাল, নগর স্বাস্থ্য কেন্দ্র, এনজিও ক্লিনিক ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে বিনামূল্যে কফ পরীক্ষা, রোগ নির্ণয়সহ যক্ষ্মার চিকিৎসা করা হয় এবং ওষুধও দেওয়া হয়।
কী ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে
সাধারণ পরীক্ষা, ত্বকের পরীক্ষা, রক্তের পরীক্ষা, কফ পরীক্ষা
অন্যান্য পরীক্ষা
বুকের এক্স-রে পরীক্ষা অথবা সিটি স্ক্যান কালচার টেস্ট
পরীক্ষার ফল নেতিবাচক হলেও অনেক সময় যক্ষ্মার সংক্রমণ হতে পারে। যেমন- যক্ষ্মার সংক্রমণের ৮-১০ সপ্তাহ পরে তা ত্বকের পরীক্ষায় ধরা পড়ে। তার আগে পরীক্ষা করলে ধরা নাও পড়তে পারে। এইডসের মতো কোনো রোগের কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে অনেকসময় পরীক্ষায় যক্ষ্মা রোগ ধরা পড়ে না।
এছাড়া এইডস এবং যক্ষ্মা রোগের লক্ষণ ও উপসর্গগুলো প্রায় এক রকম হওয়ায় এইডস রোগীদের যক্ষ্মা রোগ নির্ণয়ের বিষয়টি জটিল হয়ে থাকে। হামের টিকা নিলে এগুলোতে অনেক সময় জীবন্ত জীবাণু (Live virus) থাকে। এর জন্য ত্বক পরীক্ষায় যক্ষ্মা ধরা নাও পড়তে পারে।
শরীরে যক্ষ্মা রোগের জীবাণু বেশি মাত্রায় ছেয়ে গেলে (Overwheliming TB disease) ত্বকের পরীক্ষায় রোগের জীবাণু ধরা নাও পড়তে পারে। অনেক সময় সঠিকভাবে পরীক্ষা না করলেও এতে যক্ষ্মা রোগের জীবাণু ধরা পড়ে না।
কী ধরনের চিকিৎসা আছে?
ডটস পদ্ধতিতে অর্থাৎ স্বল্পমেয়াদী, সরাসরি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসা করা হয়। এ জন্য ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী রোগের ধরণ, মাত্রা এবং রোগীর বয়স অনুসারে ওষুধের কোর্স সম্পূর্ণ করতে হয়। যক্ষ্মার চিকিৎসার মধ্যে রয়েছে- এন্টিবায়োটিক সেবন। সাধারণত ৬-৯ মাসব্যাপী এন্টিবায়োটিক খেতে হয়। যক্ষ্মার আরকেটি উন্নত চিকিৎসা হলো হোমিওপ্যাথি।
দিবসটি উপলক্ষে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি ও বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে, প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ ও প্রচার, জেলা শহর ও সিটি করপোরেশন এলাকায় আলোচনা সভা, শোভাযাত্রা।
বিশ্বের ১০টি মৃত্যুর কারণের মধ্যে অন্যতম এই যক্ষ্মা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) জানিয়েছে, প্রতিদিন বিশ্বে ৪ হাজার মানুষ যক্ষ্মায় মারা যান এবং ৩০ হাজার আক্রান্ত হন।
জেএন/পিআর