‘ছোট ছেলে ছোট রবি, বড় হবি না? এক টানে দুই টানে কিছু হবে না!’
এই ডাক মাদকের। এই আহ্বান নেশার অন্ধকার অতলে হারিয়ে যাওয়ার। এই ডাক সেই মরণ নেশার, যে চক্রে প্রবেশ করলে বেরিয়ে আসা একরকম অসম্ভবই বলা চলে।
কারো শুরু বিড়ি-সিগারেট দিয়ে, কারো গাঁজা। আবার হাল আমলে তরুণদের মাদকে ‘অভিষেক’ হচ্ছে ইয়াবা দিয়ে। একটা সময় ফেনসিডিল ছিল নেশার জন্য তুমুল জনপ্রিয় উপকরণ। সেই বাজার এখন ইয়াবার দখলে। আর বয়স আরেকটু বাড়লে, অ্যালকোহলতো আছেই।
এ বিষয়ে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক শামীম আহমেদ জয়নিউজকে বলেন, মাদকগ্রহণ শুরু হয় ধূমপান দিয়ে। ধূমপায়ীদের একটা বড় অংশ একপর্যায়ে গাঁজা সেবন শুরু করে। তারপরের ধাপ একসময় ফেনসিডিল ছিল। এখন ফেনসিডিলের স্থান দখল করেছে ইয়াবা। বয়সে তরুণ মাদকাসক্তদের বেশীরভাগই এখন ইয়াবার দিকে ঝুঁকছেন। বয়স যাদের একটু বেশি তারা অ্যালকোহল জাতীয় মাদক গ্রহণ করে থাকেন।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, মাদকসেবীদের শতকরা ৯৮ জনই ধূমপায়ী। এদের মধ্যে প্রায় ৪৪% সন্ত্রাসী। এছাড়া রয়েছেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষিত বেকার, হতাশাগ্রস্ত তরুণ ও যুবক। উচ্চবিত্ত পরিবারের অনেক মেয়েও এখন মাদক, বিশেষ করে ইয়াবায় আসক্ত।
জানা গেছে, ‘জিরো ফিগারের জন্য’ অনেক নারী মাদক বেছে নেন। আর মাদকের টাকা জোগাড় করতে অনেক নারীতো পতিতাবৃত্তিতেই নেমে পড়েছেন।
গবেষণা বলছে, একজন মাদকসেবী নিজের পরিবার, নিজের সমাজের সবাইকে রাখে অস্বস্তিতে। মাদকসেবীর মেজাজ থাকে খিটখিটে। ফলে সবার সাথে রূঢ় আচরণ করে।
অপর এক গবেষণায় জানা যায়, ব্যক্তির মস্তিষ্কে একটি জায়গা আছে যেখানে ভাল লাগা, খারাপ লাগার তীব্র্র অনুভূতি নাড়া দেয়। যদি কোনভাবে মস্তিষ্কের বিশেষ এ জায়গাটি উদ্দীপ্ত করা যায় তাহলে আনন্দিত হয় ব্যক্তি। মাদকের ভয়াবহ সেই ক্ষমতা আছে। প্রথমদিকে মানুষ শখের বশে মাদক গ্রহণ করে। পরে যখন আসক্তি আসে তখন মাদক নেওয়ার জন্য অস্থির হয়ে যায়, যন্ত্রণায় ভোগে। যন্ত্রণা থামাতে আবার মাদক গ্রহণ করে। মাদক মানুষের মেধা, মনন ও শারীরিক শক্তি উজাড় করে নেয়।
২০১৩ সালের ১৪ আগস্ট পুলিশ ইন্সপেক্টর মাহফুজুর রহমান এবং স্ত্রী স্বপ্না রহমানকে খুন করে তাদের একমাত্র মেয়ে ঐশী। ইয়াবা আসক্ত ঐশীর বয়স তখন ছিল মাত্র ১৭ বছর! বিভিন্ন প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, তার ইয়াবা আসক্তি ১৪ বছর বয়স থেকেই। বাবা মায়ের উদাসীনতা, উশৃঙ্খল জীবন যাপন, মাদকসেবী বন্ধু-বান্ধব, ডিজে পার্টি আর অর্থের সহজলভ্যতা তাকে মাদকের দিকে ঠেলে দেয়। পরে সে ভয়ঙ্কর অপরাধ করে ফেলে। নিজের বাবা-মাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
গত শতাব্দীর আশির দশক থেকে দেশে মাদকের বিস্তার শুরু হয়। বর্তমানে আশংকাজনক হারে বেড়েছে মাদকের ব্যবহার। শুধু শহরের উচ্চবিত্ত নয়, গ্রামে-গঞ্জেও ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়েছে ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিল, প্যাথেডিনসহ নানা নেশাজাতীয় দ্রব্য।
মাদকের ব্যবহার একেবারে বন্ধ করা হয়তো সম্ভব নয়। তবে সীমান্তে কড়া নজরদারি, মাদকের উৎস নির্মূল, মাদকের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত তৈরি এবং ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সচেতনতা মাদক নির্মূলে হতে পারে সবচেয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, কেউ কৌতুহলবশত, কেউ পারিবারিক শিক্ষার অভাবে এবং কেউ কেউ চাহিদা ও প্রাপ্তির অপূর্ণতা থেকে হতাশ হয়ে মাদকে আসক্ত হয়। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি সহপাঠক্রমে আরো জোর দিতে হবে। তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারে সঠিক যত্ন নিতে হবে। যুবসমাজকে স্বপ্ন দেখাতে হবে। স্বপ্ন ছোঁয়ার সিঁড়িও দিতে হবে। আর যারা আসক্ত হয়েই গেছে তাদেরকে জীবনের পথে ফেরাতে আরো ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিতে হবে।