কয়েক’শ বছর আগের কথা। আরব দেশ থেকে সুফি সাধক হযরত বদর আউলিয়া (রহ.) আসেন এ দেশে। শহরটির গোড়াপত্তন হয় নাকি তাঁর হাতে। অনেকে বলেন, পাথরে ভেসে সমুদ্রপথে এ মহকুমায় এসেছিলেন তিনি। তাঁর জ্বালানো ‘কুপিতেই’ আলোকিত হয় নগর।
যে স্থানে কুপিটি জ্বালাতেন সন্ধ্যেবেলায় সে স্থানটি এখনো চেরাগী মোড় বলেই খ্যাত। যে স্থানে আলো জ্বালিয়ে বসতেন তিনি, সে স্থানটিও এখনো আলোকিত! তরুণ-বৃদ্ধ, সাহিত্যপ্রেমী, গান-আবৃত্তির সম্মিলনে এখানে হয় চিরতারুণ্যের সমারোহ।
নগরের রিকশাচালক আলমগীর হোসেনকে বলেছিলাম, চেরাগী পাহাড় যাবেন? ষাটোর্ধ্ব খেটে-খাওয়া মানুষটি নিমিষেই বলে দিলেন, চলেন। আবার যদি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কোনো শিক্ষার্থীকে বলা হয় চেরাগীর কথা, একমুহুর্ত না ভেবেই বলে দিতে পারবে এ স্থানটির আদ্যেপান্ত। ঠিক একইরকমভাবে আদালত পাড়ার উকিল, ডাক্তার পাড়ার মানুষদের কাছে এই স্থানটির মর্যাদা অন্যরকম। শিক্ষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক- যে কোনো পেশাজীবীর ঘুরে-ফিরে আসা হয় এখানে। চানাচুর-বাদামওয়ালাদেরও সন্ধ্যার গন্তব্য এই পথে! চায়ের কাপে ওঠে ঝড়! আড্ডা, গল্প, মাতামাতিতে মেতে থাকে এ এলাকা, সন্ধ্যা থেকে রাত অবধি।
সাহিত্যপ্রেমী আর তরুণ উদ্যোক্তাদের আসর এই চেরাগী। চেরাগী পাহাড় নামে এ চত্বর পরিচিত বলে যদি ভাবেন এখানে এলে পাহাড় দেখতে পাবেন, তাহলে কিন্তু হতাশ হতে হবে আপনাকে! চেরাগী পাহাড় নামে আলাদা কোনো পাহাড়ের অস্তিত্ব নেই এখানে। একসময় হয়তো ছিল। এখন বিলীন হয়ে গেছে কালের গর্ভে।
শতাধিক বছর আগে বদর আউলিয়া (রহ.) যে স্থানটিতে কুপি বাতি জ্বালিয়ে সন্ধ্যায় বসতেন সে স্থানটিতে নির্মাণ করা হয়েছে চেরাগের আদলে বিশাল গম্বুজ। ওই গম্বুজটির নিচে মুক্তিযোদ্ধা বশরুজ্জমান চৌধুরী, জাফর আহমদ, দীপক বড়ুয়া ও মাহবুবুল অলম চৌধুরীর নাম ফলক স্থাপন করে স্মরণ করা হয়েছে। কুপি বাতি না জ্বললেও চেরাগীর ওই বিশাল গম্বুজে সন্ধ্যা হলেই জ্বলে ওঠে মিটিমিটি বাতি। দূর থেকে ওই স্থানটি যেন আলোর মূর্ত প্রতীক হয়ে ওঠে।
প্রতীকী গম্বুজ ঘিরে চেরাগী পাহাড় এখনো জ্ঞান ও সাহিত্যের আলো ছড়ায় গোটা নগরজুড়ে। প্রতিদিন হয় আড্ডা, হয় গান-কবিতার আসর! ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ এক হাতে, অন্য হাতে সিগারেট নিয়ে সন্ধ্যার পর বসে তারুণ্যের সমৃদ্ধ আসর। সন্ধ্যায় অন্ধকার নেমে এলে বেজে ওঠে গিটারের চেনা সুর। সবমিলিয়ে শিল্প-সাহিত্য আর সাংবাদিকতার অনুপ্রেরণা এই চেরাগী পাহাড়।
চট্টগ্রামের সাংবাদিকতার ইতিহাসও এই চেরাগী ঘিরে। স্বাধীন বাংলার প্রথম পত্রিকা দৈনিক আজাদীর বেড়ে ওঠার সাক্ষী এই চেরাগী। পরবর্তী সময়ে অসংখ্য পত্রিকার যাত্রার সূচনা হয় এ স্থান থেকেই। পত্রিকা পাড়া হিসেবে তাই খ্যাতি রয়েছে চেরাগী মোড়ের।
চেরাগী ঘিরে চর্চা হয় সংস্কৃতির। চেরাগীতে চর্চা হয় মূল্যবোধের, বিপ্লবের। এই চেরাগীতে গাঁথা রয়েছে চট্টগ্রামের সাংবাদিকতার সমৃদ্ধ ইতিহাস। এই চেরাগীতে ঘিরে এখনো মেতে ওঠে প্রতিবাদী কণ্ঠগুলো।
সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচী, পথেরহাট, চাঁটগাইয়া, নওজোয়ান, আবৃত্তি সংগঠন বোধন, প্রমা, ত্রিতরঙ্গ, কিংবদন্তী, শব্দ নোঙর, নাট্য দল বিনোদিনী, ফেইম, লোক থিয়েটার, প্রতিনিধি, প্রতিভাসের মত অনেক নামকরা সংগঠনের গোড়াপত্তন হয় এই চেরাগী ঘিরেই। তাদের উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ড পরিচালিতও হয় এখান থেকে। এ সংগঠনগুলোর কার্যক্রম পরিচালনার সুবাদে চেরাগীতে গড়ে উঠেছে ‘মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী মেমোরিয়াল হল’। ও হ্যাঁ, নানান পদের খাবারের পসরা সাজিয়ে এখানে চায়ের টং, বেশ কয়েকটি রেস্টুরেন্ট আর কুলিং কর্ণারগুলো অপেক্ষায় থাকে তরুণদের।
চেরাগী নিয়ে জয়নিউজের সঙ্গে কথা বলেন জামালখান ওয়ার্ড কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন। তাঁর ভাষ্য, চেরাগী দ্যুতি ছড়ায় আন্দোলনের, আনন্দের। তারুণ্য এখানে ধরা দেয় প্রবীণদেরও। তারাও এখানে আসে শৈশব কিংবা কৈশোরের স্মৃতি হাতরাতে। চট্টগ্রামের সংস্কৃতির শত বছরের ঐতিহ্য এই চেরাগী। একজন আবৃত্তিকার, কবি কিংবা সাহিত্যিককে খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে কিনা চেরাগীতে তাঁর তারুণ্যের সময় কাটাননি। কবিতা, গান, নাটকসহ সংস্কৃতির নানান দিক নিয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী মেতে থাকবে এই চেরাগী।