চট্টগ্রামেও সারাদেশের মত বেড়েছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। সেই সঙ্গে বাড়ছে মৃত্যুও। ডেঙ্গুর বর্তমান পরিস্থিতিতে বিভিন্ন উপসর্গ নিয়ে রোগীর মৃত্যু হলেও চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ‘শক সিনড্রোম’ জটিলতায়।
গত দুই মাসের মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণে শুধু এ কারণে মারা গেছে ৪৬ শতাংশ রোগী। যা উদ্বেগের কারণ বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা।
সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামে গত ৮ মাসে ৫৩ জনের মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গুতে। বছরের প্রথম দিকে রোগীর কোন জটিলতায় মৃত্যু হয়েছে তা না জানালেও গত দুই মাস ধরে প্রায় প্রতিদিনই রোগীর মৃত্যুর কারণ জানাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি৷ এতে দেখা যাচ্ছে, ডেঙ্গুতে মৃত্যুর বেশিরভাগই শক সিনড্রোমে।
প্রতিষ্ঠানটির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত দুই মাসে ৪৪ জনের মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গুতে। এর মধ্যে ১৮ জন শক সিনড্রোমে মারা গেছেন। যা গত দুই মাসে মৃত্যুর ৪০ দশমিক ৯০ শতাংশ। এ ছাড়া ৭ জন বা ১৫ দশমিক ৯০ শতাংশ এক্সপান্ডেট সিনড্রোম এবং ৫ জন বা ১১ দশমিক ৩৬ শতাংশ হেমোরেজিক সিনড্রোম জটিলতায় মারা গেছে। তাছাড়া ২ জন ডেঙ্গু ফিভারে মারা যান। তবে বাকি ১২ জনের মৃত্যু কারণ উল্লেখ নেই জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের প্রকাশিত তথ্যে।
চট্টগ্রামে শক সিনড্রোমে মৃত্যু হওয়া ১৮ জনের মধ্যে ১০ জনই নারী। এ সিনড্রোমে ৩ শিশু ও ৫ জন পুরুষের মৃত্যু হয়।
চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গুর চারটি ধরন রয়েছে। যারা আগে একবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন এবং দ্বিতীয়বার এই চারটি ধরনের যেকোনও একটি দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের ঝুঁকি অনেক বেশি। তারাই মূলত শক সিন্ড্রোমে চলে যান বেশি। তবে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত না হয়েও শক সিনড্রোম হতে পারে।
এ সিনড্রোমে নারীরা ডেঙ্গুতে বেশি আক্রান্ত হন, কারণ তারা দেরিতে চিকিৎসা নিতে যান। এ ছাড়া বাংলাদেশের নারীদের দীর্ঘদিনের সমস্যা পুষ্টিহীনতাও রয়েছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃতদের মধ্যে বেশিরভাগই শক সিনড্রোমে মারা যাচ্ছেন। সঠিক সময়ে হাসপাতালে না যাওয়ার কারণেই শক সিনড্রোম হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের জুনিয়র কনসালটেন্ট ডা. হামিদুল্লাহ মেহেদি জানান, ডেঙ্গু আক্রান্ত যেকোনো রোগীর এ সমস্যা তৈরি হতে পারে। শক সিনড্রোম মূলত পালস, রক্তচাপ কমে যাওয়া। এ জটিলতা দেখা দিলে শরীরে বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গে রক্ত চলাচল কমে যায়, বিভিন্ন অঙ্গের কোষে যে অক্সিজেন দরকার সেই অক্সিজেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এমন অবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যেমন: ব্রেন, হার্ট, কিডনি এগুলোতে রক্ত ও অক্সিজেন পৌঁছাতে না পেরে অঙ্গগুলো আস্তে আস্তে কাজ করা বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর ‘শক সিনড্রোম’ হলে তাকে বাঁচানো কঠিন বলেও জানান তিনি।
চট্টগ্রামে শক সিনড্রোমের রোগীর মৃত্যুর হার বেশি হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি আসলে একটি বিশদ গবেষণার বিষয়। সঠিক গবেষণা ছাড়া গতানুগতিক কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না।
একই মত পোষণ করেছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকসাস ডিজিজেস (বিআইটিআইডি) এর মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মামুনুর রশীদ। তিনি বলেন, ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সঠিক কারণ অনুসন্ধানে গবেষণা জরুরি।
তিনি জানান, ডেঙ্গু রোগীদের শরীরের যে কোনও জায়গা থেকে অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ মানেই ডেঙ্গু হেমারেজিকে রূপ নিয়েছে। এর ফলে চোখে রক্ত জমে যেতে পারে, নাক, দাঁতের মাড়ি থেকে রক্ত ঝরতে পারে, মুখ, কান, মলদ্বার এরকম যেকোনো একটি বা একের অধিক অংশ দিয়ে রক্ত বের হতে পারে। বমি ও কাশির সঙ্গে রক্ত বের হতে পারে।
তিনি বলেন, যদি বিষয়টিকে আরও সহজভাবে করে বর্ণনা করি তা হলো-একজন সুস্থ মানুষের শরীরে দেড় লাখ থেকে চার লাখ প্লাটিলেট থাকে। শরীরে রক্ত জমাট বাঁধার ক্ষেত্রে প্লাটিলেট খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্লাটিলেট যখন ২০ হাজারের নিচে নেমে যাবে তখন রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়া নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। তখনই নানা জায়গা থেকে রক্ত বের হয়ে আসে। এছাড়া এক্সপান্ডেট সিনড্রোম ডেঙ্গুর আরেকটি সমস্যা। ডেঙ্গুতে অনেক সময় মারাত্মক কিছু জটিলতা তৈরি হতে পারে। এসব জটিলতায় সাধারণত লিভার, কিডনি, মস্তিষ্ক, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস ইত্যাদি অঙ্গ আক্রান্ত হতে পারে। এসব অঙ্গ যখন আক্রান্ত হয় তখন অস্বাভাবিক কিছু লক্ষণ প্রকাশিত হয়। এ জটিলতাগুলোকে এক্সপান্ডেট ডেঙ্গু সিনড্রোম বলছি।
জেএন/এমআর