চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের ইসলামপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. মামুন (৪০) মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমানে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করতেন। গত বছরের ১০ আগস্ট কাজ করার সময় বহুতল ভবন থেকে পড়ে মারা যান। ১৮ দিন পর গত ২৯ আগস্ট তার মরদেহ চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছে। এরপর স্বজনদের বুঝিয়ে দিলে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
মামুনের মতো গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে প্রবাসে মারা গেছেন চট্টগ্রামের ৪০৯ জন। এর মধ্যে কেউ দুর্ঘটনায় আবার কেউ অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন।
চট্টগ্রাম জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি কার্যালয় সূত্র জানায়, ২০২৩ সালে প্রবাসে চট্টগ্রামের ৪০৯ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে ওই বছরের জানুয়ারিতে ৪৩, ফেব্রুয়ারিতে ২৭, মার্চে ৪২, এপ্রিলে ৩৪, মে-তে ৩৪, জুনে ২৭, জুলাইয়ে ২০, আগস্টে ২৪, সেপ্টেম্বরে ৩১, অক্টোবরে ৪৪, নভেম্বরে ৩৯ ও ডিসেম্বরে ৪৮ জন। তাদের মরদেহ দেশে পৌঁছার পর স্বজনদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে দাফনের অর্থ দেওয়া হয়েছে।
দেশে মরদেহ পাঠাতে ভোগান্তির কথা জানিয়ে মামুনের আত্মীয় সৌদিপ্রবাসী ইসলামপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. ইকবাল বলেন, ‘মামুনের মরদেহ দেশে পাঠাতে দুই লাখ টাকা খরচ করেছে পরিবার। মৃত্যুর ১৮ দিন পর মরদেহ দেশে পাঠানো হয়। মৃত্যুর পর মরদেহ হিমাগারে রাখা হয়েছিল। বিমানে একটি মরদেহ পাঠাতে দুই যাত্রীর ভাড়া দিতে হয়। সরকার চাইলে দূতাবাসের মাধ্যমে প্রবাসীদের মরদেহ সরকারি খরচে দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারে। বিষয়টি নিয়ে আমরা সরকারের কাছে অনুরোধ করছি। কারণ প্রবাসীদের মরদেহ দেশে পাঠাতে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। এটি সহজ করার দাবি জানাই।’
প্রবাসে বাংলাদেশি মৃত্যুর হার বেড়েছে উল্লেখ করে ইকবাল আরও বলেন, ‘বেশিরভাগ মৃত্যু ঘটেছে হৃদরোগে। এছাড়া দুর্ঘটনার পাশাপাশি আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে। অনেকে অসুস্থ হয়ে মারা যাচ্ছেন।’
ইসলামপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা আবুধাবিপ্রবাসী সারোয়ার রানা বলেন, ‘একজন প্রবাসীর মরদেহ দেশে পাঠাতে অন্তত দুই থেকে আড়াই লাখ টাকার মতো খরচ হয়। অনেক সময় দেখা যায়, মারা যাওয়া ব্যক্তি অসচ্ছল হলে কিংবা আত্মীয়-স্বজন না থাকলে প্রবাসের অনেক সংগঠন টাকা-পয়সা তুলে মরদেহ দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। দেশে পাঠাতে অনেক সময় বিমানের শিডিউলের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয়। আবার অনেক সময় অর্থের অভাবে দেশে পাঠানো না গেলে প্রবাসে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়।’
রাউজান উপজেলার বাসিন্দা শেখ নবী বলেন, ‘যারা বৈধপথে প্রবাসে যান, তাদের মরদেহ দেশে আনা কিছুটা সহজ। তবে অবৈধপথে যাওয়া প্রবাসীদের মরদেহ দেশে আনতে নানা ঝামেলা পোহাতে হয়। বিষয়টি আরও সহজ করা প্রয়োজন।’
এসব বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘প্রবাসে শ্রমিকের ভিসায় গিয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মরদেহ পরিবহন ও দাফন বাবদ ৩৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়। পাশাপাশি বৈধ কর্মীর ওয়ারিশদের তিন লাখ টাকা দেওয়া হয়। দ্রুত সময়ের মধ্যে মরদেহ দেশে আনার চেষ্টা করলেও অনেক সময় বিমানের শিডিউল না পাওয়ায় আনা সম্ভব হয় না।’
জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, ২০২৩ সালে প্রবাসীদের মরদেহ দাফন ও পরিবহন বাবদ স্বজনদের এক কোটি ২৪ লাখ ৯৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। একইভাবে ২০২২ সালে এক কোটি ২৪ লাখ ৯৫ হাজার, ২০২১ সালে ৫০ লাখ ৪০ হাজার, ২০২০ সালে ৫৯ লাখ ৮৫ হাজার, ২০১৯ সালে এক কোটি ৪৪ লাখ ৯০ হাজার এবং ২০১৮ সালে এক কোটি ২৯ লাখ ৮৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে।
ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, একজন কর্মী মারা যাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট দেশের কর্তৃপক্ষ মৃত্যুর কারণ লিখিতভাবে জানায়। দূতাবাস সেটি কল্যাণ বোর্ডে পাঠায়। সেই হিসাবে ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে ১৮ হাজার ১৬৬টি মরদেহ এসেছে দেশে। এর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা, কর্মস্থলে দুর্ঘটনা, আগুনে পোড়া, ভবন থেকে পড়ে যাওয়া ও বৈদ্যুতিক শকে মারা গেছেন তিন হাজার ৬৯৮ প্রবাসী। সবচেয়ে বেশি মারা গেছেন সড়ক দুর্ঘটনায়, দুই হাজার ৬৪৯ জন। কর্মক্ষেত্রে আসা-যাওয়ার সময় এসব দুর্ঘটনা ঘটে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
জেএন/এমআর