ইউরোপগামী যাত্রী জানে আলমের পাসপোর্টে ফ্রান্সের তিন মাসের ভিসা স্টিকার। তবে তিনি এই ভিসা পেতে দেশটির ঢাকাস্থ দূতাবাসে আবেদনই করেননি! একই ধরনের ভিসা স্টিকার সম্রাট সওদাগর আর সাব্বির মিয়া নামে আরও দুই তরুণের পাসপোর্টেও। সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাসে ভিসা আবেদন না করে পাসপোর্টে স্বপ্নের ইউরোপের ভিসা স্টিকারে তৈরি করে দিচ্ছে দালাল চক্র। তারা ফ্রান্সে চলে যাওয়ার প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন। ভয়ংকর তথ্য হচ্ছে, এই চক্রে জড়িয়ে পড়েছে খোদ এয়ারলাইন্সের অসাধু কর্মীরাও। ইউরোপের জাল ভিসা চক্রে জড়িত বিমান বাংলাদেশ ও কুয়েত এয়ারওয়েজের দুই কর্মী গোয়েন্দাদের হাতে গ্রেপ্তারের পর এই তথ্য বেরিয়ে আসে।
ওই তিন তরুণ জাল ভিসায় ফ্রান্স যাওয়ার প্রস্তুতির সময়ে গত বুধবার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তাদের গ্রেপ্তার করে। পরে জাল ভিসা চক্রের অন্যতম হোতা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের নিরাপত্তা বিভাগের কর্মী আসাদুজ্জামান ও কুয়েত এয়ারওয়েজের বুকিং সহকারী কবির হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে এই চক্রের নানা তথ্য।
এ চক্রটির সঙ্গে এয়ারলাইন্সের সিনিয়র কর্মকর্তা, স্টেশন ম্যানেজার, সুপারভাইজারও জড়িত থাকতে পারে বলে সন্দেহ করছেন গোয়েন্দারা। তাদের বিষয়ে বিস্তারিত তদন্ত শুরু হয়েছে। পাশাপাশি ওই দুজনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত জাল সেনজেন ভিসা তৈরি করে দিতে জনশক্তি রপ্তানির নামে গড়ে ওঠা দালাল চক্র। আসাদুজ্জামান ও কবিরের কাজ ছিল জাল ভিসার যাত্রীদের উড়োজাহাজ পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া। ওই যাত্রীরা ঢাকা থেকে উড়োজাহাজে যেতে পারলেও কোথাও না কোথাও ভিসা তল্লাশির সময়ে ধরা পড়তেই। এতে জরিমানার মুখে পড়তে হতো সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইন্স কোম্পানিকে। পাশাপাশি ঢাকায় বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েও প্রশ্ন উঠত।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, মানব পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়ে লাখ লাখ টাকা খুইয়ে বিভিন্ন পন্থায় লোকজন সেনজেন ভিসাভুক্ত ইউরোপিয়ান দেশগুলোতে যাওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। এই সুযোগে দালাল চক্র জাল ভিসা ধরিয়ে দিয়ে ইউরোপ যেতে ইচ্ছুক যাত্রীকে বিপদে ফেলে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
তিনি বলেন, এক সময় নৌপথে লিবিয়া হয়ে ইউরোপিয়ান দেশ ইতালিতে লোকজন পাঠানোর চেষ্টা করত দালাল চক্র। ওই পথে অনেকে মারা যেতেন। অনেকে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হতেন। নৌপথে ইউরোপ যাওয়ার পথ কঠিন হয়ে যাওয়ায় নতুন পন্থা অবলম্বন করছে দালাল চক্রের সদস্যরা। এয়ারলাইন্সের সিকিউরিটি ম্যান, বুকিং সহকারী, কিছু জনশক্তি রপ্তানি প্রতিষ্ঠান ও ট্রাভেল এজেন্সিসহ কম্পিউটার অপারেটর মিলে শক্তিশালী একটি চক্র সেনজেনভুক্ত দেশগুলোর জাল ভিসা তৈরি করে আকাশপথে ইউরোপ পাঠানোর অপচেষ্টা করছে।
ডিবিপ্রধান বলেন, এই দালাল চক্র মূলত ট্যুরিস্ট ভিসার কথা বলে সেনজেন ভিসাভুক্ত দেশে কোনো রকম পাঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এজন্য ১৬ থেকে ১৮ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
বিমান ও কুয়েত এয়ারওয়েজের দুই কর্মীকে গ্রেপ্তার অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া ডিবির লালবাগ বিভাগের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত ডিআইজি মশিউর রহমান কালবেলাকে বলেন, জাল ভিসা নিয়ে ফ্লাইটের বুকিং পাস পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু বিমানের নিরাপত্তাকর্মী আসাদুজ্জামান ও কুয়েত এয়ারের কর্মী কবির জাল ভিসা জেনেও যাত্রীদের ফ্লাইট বুকিং পাস দিতেন। এরপর এরা সেই যাত্রীদের সুযোগ বুঝে ইমিগ্রেশন পার করে উড়োজাহাজের গেটের কাছাকাছি পার করে দিতেন। এতে জালভিসাধারী যাত্রীদের বিষয়ে বিমানবন্দরের অন্য কর্মকর্তাদের সন্দেহ কম হতো।
তিনি বলেন, এই জাল ভিসায় বাংলাদেশ থেকে গন্তব্যের দেশে পৌঁছানোর আগেই অনেকে ধরা পড়ছে। অনেকে ফ্লাইটের মধ্যবর্তী ট্রানজেটিং কান্ট্রিতে ধরা পরে নাজেহাল হচ্ছে। পথ থেকেই ফেরত আসতে হচ্ছে দেশে। কেউ কেউ ইউরোপে পৌঁছতে পারলেও বিমানবন্দরেই জেলে যাচ্ছে।
জাল ভিসা নিয়ে ইমিগ্রেশন পার হতো কীভাবে জানতে চাইলে ডিবির অপর একজন কর্মকর্তা বলেন, একজন যাত্রীর পাসপোর্ট বৈধ, সেই পাসপোর্টে ভিসা আছে। বৈধ টিকিটও আছে। তখন ইউরোপের যাত্রীদের সাধারণত ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা হয়তো হাল্কাভাবে দেখেন। তা ছাড়া এই ধরনের জাল ভিসার চুক্তিভুক্ত যাত্রীদের সঙ্গে এয়ারলাইন্সের কর্মকর্তারা ইমিগ্রেশন পর্যন্ত যাচ্ছেন। তারা বিমানবন্দরে দায়িত্ব পালন করায় ফাঁকফোকর দিয়ে ইমিগ্রেশন পার করে দিচ্ছেন। তবে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি জড়িত অন্যদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে।
জাল ভিসা নিয়ে গ্রেপ্তার হওয়া তিন যাত্রী জানে আলম, সম্রাট সওদাগর ও সাব্বির মিয়া জানিয়েছেন, তারা ইউরোপে যেতে চেয়েছিলেন। এ জন্য ১৬ থেকে ১৮ লাখ করে টাকা দিয়েছেন। তাদের বলা হয়েছিল, এয়ারলাইন্সের লোকজন উড়োজাহাজে তুলে দেবে। ফ্রান্স গেলে তাদের লোকজন রিসিভ করবে। তাদের পাসপোর্টে থাকা ভিসা যে জাল, তা তারা জানতেন না।
ডিবি কর্মকর্তারা বলছেন, ওই তিন তরুণের মতো শত শত তরুণ জাল সেনজেন ভিসা চক্রের খপ্পরে পড়ে লাখ লাখ টাকা খুইয়েছে। অনেকে গন্তব্যের দেশে গিয়ে ধরা পড়ার পর জেল খাটছে।
জেএন/এমআর