চট্টগ্রাম শহরকে নিরাপত্তার আওতায় আনতে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উদ্যোগে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে স্থাপন করা হয়েছে ক্লোজড সার্কিট টেলিভিশন (সিসিটিভি) ক্যামেরা। এতে পুরো শহরজুড়ে নিরাপত্তার চাদরে ডেকে যাওয়ার কথা।
তবে অপরাধীকে চিহ্নিত করতে সিসি ক্যামেরা বিশেষ ভূমিকা রাখলেও অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থ হচ্ছে। কোথাও আবার কাজই করছে না। দেখা গেছে, অপরাধের ঘটনাস্থল বা আশপাশে থাকা সিসি ক্যামেরা বিকল হয়ে আছে। এতে তদন্তে বেগ পোহানোর পাশাপাশি অপরাধও ঢাকা পড়ে যাচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে চুরি ছিনতাইসহ নানান অপরাধ কর্মকান্ড তদন্ত করতে গিয়ে ক্যামেরা নষ্ট থাকায় আসামি ধরতে ব্যর্থ হচ্ছে পুলিশ। ফলে বারবার ঘটনা ঘটিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে অপরাধীরা।
গতকাল রবিবার দুপুর দেড়টার সময় চট্টগ্রাম নগরীর লালখান বাজার এলাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলেও সিসি ক্যামেরা নষ্ট থাকায় ছিনতাইকারীদের সনাক্ত করতে পারছে না প্রশাসন।
ছিনতাইয়ের শিকার কিশোর মো. জসীম জয়নিউজবিডিকে জানান, রবিবার দুপুরে বহদ্দারহাট থেকে সিএনজি নিয়ে আগ্রাবাদ যাচ্ছিলাম। ১টা ২০ মিনিটের সময় লালখান বাজার ফ্লাইওভার থেকে নামতে ইস্পাহানী টাওয়ারের সামনে দুজন লোক পুলিশ পরিচয়ে পথ আটকায়।
তারা ভয়ভীতি দেখিয়ে আমার শরীর তল্লাশী করে পকেটে থাকা ৩৭ হাজার টাকা ছিনিয়ে পালিয়ে যায়। পরে আমি কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশকে সাথে নিয়ে ঘটনাস্থলে গেলেও তাদের পাইনি।
পরে এ বিষয়টি কোতোয়ালী থানাকে অবহিত করলে আমাকে সাথে নিয়ে একটি টিম ঘটনাস্থলে যায়। আশে পাশে সিসিটিভি ক্যামেরা থাকলেও সেগুলো নষ্ট থাকায় ফুটেজ সংগ্রহ করতে পারেনি পুলিশ।
ফলে কাউকে চিহ্নিত করা যায়নি। পুলিশও জানিয়ে দিলো আর কিছু করার নেই। ঠিক এভাবেই সিসি ক্যামেরার কারণে বহু ঘটনায় অপরাধী ধরতে বেগ পেতে হচ্ছে প্রশাসনকে।
অলি খাঁ নামে এক ব্যবসায়ী হাসির ছ্বলে বলে ফেললেন, চোখ (সিসিটিভি) থাকতেও যেন অন্ধ চট্টগ্রাম শহর। মোড়ে মোড়ে সিসি ক্যামেরা থাকলেও এসব ক্যামেরায় ফুটেজ ধারণ হয় না। কারণ অধিকাংশই নষ্ট। ফলে অপরাধীরা নষ্ট সিসিটিভির আওয়তাধীন এলাকাকেই বেচে নেয় চুরি ছিনতাইয়ের জন্য।
জানা গেছে, ২০১৪ সালে চট্টগ্রাম মহানগরীতে প্রথম ২৫টি স্পটে ১১০টি ক্যামেরা স্থাপন করা হলেও সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে প্রায় সবগুলোই অকেজো হয়ে পড়ে। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ না থাকায় অপরাধী ধরতে বিলম্ব হয়। এতে সমালোচনার মুখে পড়ে প্রশাসন।
২০২০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি রাতে ষোলশহর ২ নম্বর গেট এলাকায় ট্রাফিক পুলিশ বক্সে বিস্ফোরণে পাঁচজন আহত হয়। পুলিশ প্রথমে এটাকে বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে বিস্ফোরণ বলে মনে করলেও প্রাথমিক তদন্তের পর জানিয়েছে, পরিকল্পিতভাবে নাশকতার উদ্দেশ্যে নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে পুলিশ বক্সে।
ওই ঘটনায় সিএমপির কাউন্টার টেররিজম ইউনিট তদন্তে নামে। কিন্তু ঘটনাস্থলের আশপাশে কোনো সিসি ক্যামেরা সচল না পাওয়া যাওয়ায় অপরাধী শনাক্তে হিমশিম খেতে হয় তাদের।
পুলিশ বক্সের ৫০ গজের মধ্যে বিপ্লব উদ্যানের সামনে থেকে নাসিরাবাদমুখী দুটি ক্যামেরা, বিপ্লব উদ্যানের উল্টো দিকে মসজিদ থেকে ব্রিটিশ কাউন্সিলের সামনের সড়ক অভিমুখী একটি ক্যামেরা ওই ঘটনার অনেক আগে থেকেই অকেজো হয়ে আছে।
এদিকে খুন, ছিনতাই, অপহরণসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে বিস্মিত হয়েছেন নগরবাসী। তারা ক্ষোভ ঝাড়ছেন পুলিশের ভূমিকা নিয়ে।
পরবর্তীতে ২০২১ সালের নভেম্বরে চট্টগ্রাম নগরীকে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার (সিসি ক্যামেরা) আওতায় আনতে আরো ৭শ স্পটে ক্যামেরা স্থাপনের কার্যক্রম শুরু করে সিএমপি।
নগরীর জিইসি মোড়, ষোলশহর, বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, টাইগার পাস, অক্সিজেন, পতেঙ্গাসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এসব সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়। সিএমপির নিজস্ব উদ্যোগের পাশাপাশি কোনো কোনো স্থানে ব্যক্তিগত উদ্যোগেও ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে।
তবে সব ক্যামেরা মনিটরিংয়ের জন্য সিএমপির সদর দফতরে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালু করে তৎকালীন পুলিশ কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর। নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে বসে একজন অফিসার তা পর্যবেক্ষণ করে। এসব ক্যামেরা দিন-রাত পর্দায় সচল রেখে সব ফুটেজ ১৫দিন পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকার কথা।
তখন সিএমপি’র পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, পুুরো নগরীকে সিসি ক্যামেরার আওতায় নিয়ে আসা হবে। এতে চোর, ছিনতাইকারী কিংবা প্রকাশ্যে আইন-শৃঙ্খলা অবনতির সঙ্গে জড়িতদের সহজে চিহ্নিত করা যাবে।
কিন্তু অধিকাংশ অপরাধ ঘটলেও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। আর যেসব বাসা বাড়ি ও অফিসের সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে, সেগুলোর রেজুলেশন অনেক কম বলে অনুসন্ধানে জানা যায়। আর এ কারণে দূরের ভিডিওগুলো অনেকটা অস্পষ্ট।
চট্টগ্রাম নগরীর আগ্রাবাদ এলাকার বাসিন্দা রহিম উল্লাহ প্রশাসনের ওপর ক্ষোভ ঝেরে বলেন, সিএমপির উদ্দ্যেগে বসানো কিংবা ব্যক্তি উদ্দ্যেগে লাগানো সিসি ক্যামেরাগুলোর মূল কার্যক্রম না থাকলেও, হালে সেগুলো শুধুই লোক দেখানোর কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।
দেয়ালে দেয়ালে বা বিভিন্ন বাসার সামনে সিসি ক্যামেরা আছে। তবে অধিকাংশ সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংরক্ষণ করার মনিটর বা যন্ত্রপাতি নেই।
আবার অনেক এলাকায় রাস্তায় লাগানো সিসি ক্যামেরা মাসের পর মাস নষ্ট থাকলেও সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধির কোনো তৎপরতা না থাকায় মাসের পর মাস অচল পড়ে রয়েছে অপরাধ দমনে মূল্যমান সিসি ক্যামেরা।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, আগের স্থাপিত বহু সিসি ক্যামেরায় গাছপালা, লতাপাতা ঘিরে আছে। কোনোটির ওপরের অংশ (ঢাকনা) ভেঙে আছে।
যত্রতত্র বৈদ্যুতিক খুঁটি এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডের কারণে গতিবিধি ঠিকভাবে কাভার করা যাচ্ছে না। কোনো কোনো সিসি ক্যামেরার ভেতর পানি জমে থাকতেও দেখা গেছে। এগুলো স্থাপনের পর রক্ষণাবেক্ষণ হয় না বলে চলে। অকেজো হয়ে থাকার বিষয়টি জানা গেছে স্থানীয় পুলিশ, মাঠে দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ভাষ্য থেকে। ফলে অপরাধীরা অপরাধ করেই পার পেয়ে যাচ্ছে অনাশয়ে।
সিএমপি সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে নগরীর নিউ মার্কেট, শাহ আমানত গোল চত্বর, জিইসি মোড়, মুরাদপুর মোড়, আকবরশাহ মোড়, রাহাত্তারপুল, বহদ্দারহাট, চকবাজার, সাগরিকা, অক্সিজেন, পিএইচপি স্পিনিং মিল, সিটি গেট, কাজীর দেউড়ি, কাপ্তাই রাস্তার মাথা, দেওয়ানহাট ব্রিজ, সিইপিজেড, ইস্পাহানি মোড়, অলংকার মোড়, বাদামতলী, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, বড়পোল, প্রবর্তক মোড়, নিমতলা বিশ্বরোড, টেরিবাজার, সল্টগোলা, দুই নম্বর গেট, নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটি, অক্সিজেন চেকপোস্ট, সিটি গেট চোকপোস্ট, কোর্ট বিল্ডিংসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে সিএমপির সিসি ক্যামেরা রয়েছে। তবে বর্তমানে এসব এলাকার অধিকাংশ ক্যামেরা অনেকটা অচল।
সিসিটিভি ক্যামেরা অচল থাকার বিষয়টি স্বীকার করে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের এক কর্তকর্তা জানান, ক্যামেরা গুলো প্রায় ২ বছর আগে লাগানো। বর্তমানে কিছু সচল আছে। কিছু ক্যামেরা অচল রয়েছে। আমরা এগুলো নতুন করে সংস্কার করার উদ্যোগ নিয়েছি। অল্প সময়ের মধ্যে অচল ক্যামেরাগুলো সচল করা হবে।
অপরাধ বিশ্লেষকরা জানান, চট্টগ্রাম শহরে নামমাত্র বহু সিসি ক্যামেরা আছে। বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে উন্নত বিশ্বে সিসি ক্যামেরার ধরন, বাস্তবায়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ বিষয়গুলো বিশেষ করে আমলে আনতে হবে।
এছাড়া কোন অবস্থানে ক্যামেরাটি লাগানো হয়েছে তার ওপরও ফলাফল নির্ভর করে। বর্তমানে থাকা কিংবা আগামী দিনে স্থাপিত সিসি ক্যামেরাগুলো ঠিকমতো কাজ করছে কি না বা তা দিয়ে কী উপকার হচ্ছে-এ বিষয়েও রিসার্চ থাকতে হবে।
দ্রুত সময়ের মধ্যে অকেজো সব ক্যামেরা সচল করে শুধু অভিজাত এলাকা নয়, পুরো চট্টগ্রাম শহরকেই সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা জরুরি।
এদিকে চট্টগ্রামে বেশিরভাগ খুন, ছিনতাইসহ নানা অপরাধ কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত অপরাধী শনাক্ত করা হয়েছে বিভিন্ন ভবনে লাগানো ব্যক্তিমালিকানাধীন সিসি ক্যামেরা থেকে। আর যেসব বাসাবাড়ি ও অফিসে সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে, সেগুলোর রেজুলেশন অনেক কম।
এ কারণে দূরের ভিডিওগুলো অনেকটা অস্পষ্ট। সাম্প্রতিক সময়ে খুন, ছিনতাই, অপহরণসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বাড়ায় নগরবাসী ক্ষোভ ঝাড়ছেন পুলিশের ভূমিকা নিয়ে।
সনাক-টিআইবির চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি অ্যাডভোকেট আক্তার কবির চৌধুরী বলেন, নাগরিক নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে যারা এর দায়িত্বে তারা দায় এড়াতে পারেন না।
দ্রুত ক্যামেরাগুলো মেরামত ও গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় আরও ক্যামেরা স্থাপন করা না গেলে নগরীতে অপরাধপ্রবণতা বাড়বে।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় বলেন, সিএমপির উদ্দ্যেগে বসানো কিছু ক্যামেরা চালু আছে। আর কিছু কিছু সংস্কারের অভাবে নষ্ট হয়ে গেছে। এগুলো স্থাপন ও নিয়মিত দেখভাল এবং সংস্কার করা মূলত সিটি করপোরেশনের কাজ।
আমরা সিটি করপোরেশনকে অনুরোধ করেছি তারা যেন এ কাজটি করে। এখন নিরাপত্তার কারণে আমরা বন্ধ সিসি ক্যামেরাগুলো চালু করার কাজ করছি। সেই সঙ্গে চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ স্পটগুলোতে বিশেষায়িত ক্যামেরা স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছি।
জেএন/পিআর