তীব্র গ্রুপিং আর একাধিক প্রার্থী নিয়ে হাটহাজারীতে বিএনপি রয়েছে বেকায়দায়। এ আসনে দলটির প্রার্থীদের নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে রাজনীতির মাঠও এখন সরগরম। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সমালোচনায়ও স্থান পেয়েছেন বিএনপি প্রার্থী ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানা।
অন্যদিকে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মীর নাছির ও তার ছেলে মীর হেলাল অযোগ্য বিবেচিত হলে এ আসনে বিএনপির কান্ডারী কে হবে তা জানতে হলে অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছু সময়। কারণ ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন কমিশনে আপিল করা প্রার্থীদের বিষয়ে ৬ থেকে ৮ ডিসেম্বরের মধ্যে সিদ্ধান্ত জানাবে সংস্থাটি। আবার নির্বাচনে যোগ্য হলেও মীর নাছির, মীর হেলাল নাকি শাকিলা- কার হাতে উঠছে ধানের শীষ, সে সিদ্ধান্ত জানাবে দলের হাইকমান্ড।
জানা গেছে, ঐতিহ্যগতভাবে হাটহাজারীতে (চট্টগ্রাম-৫) রয়েছেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিএনপির ভোটার। স্বাধীনতার পর এ আসনে একবারই বিজয়ী হয়েছিল নৌকা। সেই নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থী ছিলেন এমএ ওয়াহাব। এ সংসদীয় আসনের বাকি ইতিহাস বিএনপির।
হালে এ আসনে দুই বার নির্বাচিত হয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। যদিও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট অংশ নেয়নি। একপ্রকার ‘খালি মাঠেই’গোল দিয়ে সাংসদ হয়েছেন তিনি।
তৃতীয়বারের মত এবার এ আসনে মহাজোট মনোনীত প্রার্থী ব্যারিস্টার আনিস। তার সঙ্গে নির্বাচনি লড়াইয়ে নামতে চান জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানা। তার আরেক পরিচয়, এ আসন থেকে চার বারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য বিএনপির সংসদীয় দলের সাবেক হুইপ মরহুম ওয়াহিদুল আলমের মেয়ে তিনি।
এছাড়া মনোনয়ন পেয়েছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মীর নাছির ও তার ছেলে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মীর হেলাল। যদিও প্রার্থিতা বাছাইয়ে এ দুই প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। এছাড়াও আছেন ২০ দলীয় জোটের শরিক কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিমও। নির্বাচন কমিশনে আপিল করা মীর নাছির ও মীর হেলাল যদি নির্বাচনি মাঠে যোগ্য ঘোষিত না হন সেক্ষেত্রে হিসেবটা হবে শাকিলা ও ইব্রাহিমের মধ্যে।
হাটহাজারীর রাজনীতির সমীকরণ বলছে, বিএনপি মনোনীত প্রার্থীকে সামলাতে কিছুটা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে মহাজোট প্রার্থী ব্যারিস্টার আনিসকে। এক্ষেত্রে জোটের হিসেবে যদি মেজর জেনারেল ইব্রাহিমের হাতে ধানের শীষ প্রতীক বরাদ্দ হয় তাহলে আনিসের সঙ্গে নির্বাচনি মাঠে তিনি পেরে উঠবেন কি-না সে প্রশ্ন রয়েই যায়।
আবার মীর পরিবারের সঙ্গে ওয়াহিদ পরিবারের দূরত্ব না ঘুচিয়ে কাউকে যদি মনোনয়ন দেওয়া হয় তাহলে নির্বাচনি বৈতরণী পার হতে অনেকটাই ভুগতে হবে বিএনপিকে।
জানা গেছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কোনো নেতা হাটহাজারী আসনে নির্বাচনের সুযোগ পাচ্ছেন না। মহাজোটের সমীকরণে জাতীয় পার্টির লাঙল প্রতীক নিয়ে নির্বাচনি মাঠে নামতে হবে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের।
ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে বিএনপি নির্বাচন করার ঘোষণা দেওয়ার পর এ আসনের নির্বাচনি হাওয়ায় লেগেছে উত্তাপও। কারণ বিএনপির ভোট ব্যাংক হিসেবে খ্যাত এ আসনে রয়েছেন দলের বেশ কয়েকজন হেভিওয়েট প্রার্থী। ফলে নির্বাচনি হিসেব-নিকেশে জাতীয় পার্টির আনিসকে মেলাতে হবে জটিল সব সমীকরণ।
কারণ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের অভিযোগ, গত দশ বছর আনিস তাদের যথাযথ মূল্যায়ন করেননি। হাটহাজারীর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের তিনি চিনতেন না। এই অভিযোগ তোলা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা তার হয়ে লাঙল কাঁধে হাঁটতে কতটা আন্তরিক হবেন তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে নির্বাচন পর্যন্ত।
এ বিষয়ে হাটহাজারী উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল আলম মনি জয়নিউজকে বলেন, হাটহাজারীতে নৌকা প্রতীক নিয়ে কোনো প্রার্থী সর্বশেষ নির্বাচন করেছিলেন ২০০১ সালে। এরপর এই আসনে গত ১৮ বছরে যারা ভোটার হয়েছেন তাদের কেউ সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক দেখেননি। তাই আমাদের আশা ছিল, এ আসনে এবার নৌকা প্রতীকের প্রার্থী পাবো। কিন্তু জোটের হিসেবের কারণে দল জাতীয় পার্টি থেকে প্রার্থী দিয়েছে। নেত্রীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা জোটের প্রার্থীকেই বিজয়ী করতে কাজ করবো। নেত্রীকে এ আসনটি আমরা উপহার দিব।
অন্যদিকে মীর নাছির কিংবা মীর হেলাল নির্বাচনে চূড়ান্তভাবে অযোগ্য বিবেচিত হলে এ আসন থেকে বিএনপির প্রার্থী হতে পারেন ব্যারিস্টার শাকিলা। ওয়াহিদুল আলমের মেয়ে হিসেবে হাটহাজারীর ভোটারদের আগ্রহ-আলোচনায় আছেন তিনি। বৃহত্তর চট্টগ্রামে বিএনপির মহিলা প্রার্থী হিসেবেও হেভিওয়েট শাকিলা। দেশের বড় দুই দল যখন সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক উত্তেজনাপূর্ণ সময় পার করছে, ঠিক সে মুহুর্তে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের মুখে উঠে এসেছে শাকিলার বিরুদ্ধে সমালোচনা।
শাকিলার বিরুদ্ধে হামজা বিগ্রেড নামে একটি নিষিদ্ধ সংগঠনের অর্থায়নের অভিযোগে মামলা রয়েছে। এটিকে ঢাল হিসেবে দেখিয়ে ২৯ নভেম্বর ঢাকার ধানমণ্ডিতে দলীয় সভাপতির কার্যালয়ে বিএনপির সমালোচনা করেন ওবায়দুল কাদের। তবে এ সমালোচনা তার রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন বিএনপি ও অঙ্গসংঠনের নেতাকর্মীরা।
তবে দলের মনোনয়ন পেলেও ওয়াহিদুল কন্যা শাকিলার নির্বাচনি বৈতরণী পার হতে মাথায় রাখতে হবে মীর নাছির পরিবারকে। এ দুই পরিবারের মধ্যে রয়েছে ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব। আবার মীর নাছির পুত্র মীর হেলালের ছাত্রদল, যুবদলে রয়েছে ভাল অবস্থান। উত্তর জেলা ছাত্রদলের বড় একটির অংশের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে তাঁর হাতে। ফলে নির্বাচনের হিসেব মেলাতে হলে এ বিষয়টির দিকেও নজর রাখতে হবে শাকিলার।
চট্টগ্রাম উত্তর জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নুরুল হুদা সোহেল জয়নিউজকে বলেন, দল যাকে মনোনয়ন দেয় তাকে বিজয়ী করতে হাটহাজারী বিএনপি ঐক্যবদ্ধ। এক্ষেত্রে সবাই এক। বিএনপি প্রার্থী হাটহাজারীর গণমানুষের নেতা প্রয়াত সৈয়দ ওয়াহিদুল আলমের মেয়ে ব্যারিস্টার শাকিলাকে আওয়ামী লীগ ভয় পায় বলেই তার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করছে। বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত আসনটি পুনরুদ্ধার করতে দলের উচিত বিএনপি থেকে প্রার্থী দেওয়া।
উত্তর জেলা ছাত্রদলের যুগ্ম সম্পাদক তকিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, মীর নাছির ও মীর হেলালকে অবৈধ সরকারের প্রশাসন নীলনকশা অনুযায়ী নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার চেষ্টা করছে। কারণ তারা আওয়ামী লীগের আতংক। আশা করি নির্বাচন কমিশনে করা আপিলে তারা যোগ্য বিবেচিত হয়ে দেশনেত্রীর হাতে এ আসনটি উপহার দিবেন। উত্তর জেলা বিএনপি ঐক্যবদ্ধ হয়েই এবারের নির্বাচনে ধানের শীষকে বিজয়ী করে আনবে।
জয়নিউজ/জুলফিকার