ভারত মহাসাগরে গতকাল মঙ্গলবার সোমালিয়ান জলদস্যুদের দ্বারা জিম্মি হয়েছে বাংলাদেশি পতাকাবাহী কবির স্টিলের মালিকানাধীন জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ। জাহাজটিতে নাবিক, ক্রু মিলিয়ে রয়েছেন ২৩ জন। যাদের বেশীরভাগের বাড়ি চট্টগ্রাম। এদের একজন তানভীর আহমেদ, তার মা জোৎস্না বেগমের বয়স ৫০ এর ঘরে। হাতে তার ছেলের ছবি, আর চোখের কোণে অশ্রু। চতুর্থ ইঞ্জিনিয়ার হয়ে আছেন জিম্মি জাহাজে; তার উদ্বিগ্ন মা ছুটে এসেছেন জাহাজটির মালিকপক্ষ কেএসআরএম কর্তৃপক্ষের কাছে। জোৎস্না বেগম কাঁদছেন আর বলছেন, ‘আমার মানিক কোথায়? তারে আমার সামনে আনেন। আমি আমার মানিকরে বুকে নেব।’
জোৎস্না বেগম যখন এসব কথা বলছিলেন তখন কেএসআরএমের অফিসে তার পাশেই ছিলেন জিম্মি হওয়া নাবিকদের আরও অন্তত এক ডজন স্বজন। তাদের কেউ এসেছেন ভাইয়ের খোঁজে, কেউ স্বামীর। তাদেরই একজন জান্নাতুল ফেরদৌস। জিম্মি নাবিক নুরউদ্দিনের স্ত্রী তিনি। স্বামীর সঙ্গে শেষ কথোকপথনের তথ্য জানিয়ে তিনি বলেন, ‘গতকাল সন্ধ্যার পর তার সঙ্গে শেষ কথা হয়েছে। সে বলেছে, বিপদে আছে। মুক্তিপণ না পেলে জলদস্যুরা তাদের মেরে ফেলবে। তাদের মুক্ত করতে আমরা যেন মালিকপক্ষের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ করি। তাই এখানে ছুটে এসেছি।’
জান্নাতুল যখন এসব কথা বলছিলেন তখন পাশেই ছিলেন কেএসআরএম গ্রুপের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমরা বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। জলদস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছি। তারা এখনও কোনো যোগাযোগ করেনি। সাধারণত দু-তিন সপ্তাহ সময় নিয়ে যোগাযোগ করে তারা। আমরা ২৩ নাবিকের সবাইকে নিরাপদে ফিরিয়ে আনতে যা যা করার দরকার সব করব।’
জানতে চাইলে প্রিন্সিপাল অফিসার ক্যাপ্টেন সাব্বির মাহমুদ বলেন, ‘জাহাজের ডেক ক্যাডেটের কাছ থেকেই জলদস্যু আক্রমণ হওয়ার কথা প্রথম জানতে পারি আমরা। পরে তার সঙ্গে কথা হয়েছে জাহাজটির মালিকপক্ষেরও।’
বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘জাহাজের ডেক ক্যাডেট হোয়াটসআপে মেসেজটি পাঠান আমাদের সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক ইফতেখারুল আলমের কাছে। তিনি জাহাজ নিয়ে দক্ষিণ চায়নাতে রয়েছেন। মেসেজটি তিনি আমাদের সভাপতির কাছে ফরোয়ার্ড করেছেন। এর পরে গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যার দিকে চিফ ইঞ্জিনিয়ার আরেকটি মেসেজ দিয়েছেন মালিকপক্ষের প্রধান নিবার্হীর কাছে। সেখানে তারা নিরাপদে আছেন বলে জানিয়েছেন। জাহাজটি জলদস্যুরা সোমালিয়া উপকূলের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। আজ সকালে সোমালিয়ার উপকূল থেকে এটি প্রায় ৩০০ নটিক্যাল মাইল দূরে ছিল।’
শুধু এমভি আবদুল্লাহ নয়; আরও অনেক জাহাজের বাংলাদেশি নাবিক ও ক্র সোমালিয়ান জলদস্যুদের কাছে অতীতে জিম্মি হয়েছিলেন। তাদের কেউ ২০ মাস পর, কেউ ১০ মাস পর জিম্মি দশা থেকে মুক্তি পান। ২০১২ সালে সোমালিয়ান জলদস্যুদের হাতে ২০ মাসেরও বেশি সময় জিম্মি থাকার পর বাংলাদেশি সাত নাবিক মুক্তি পান। ২০১০ সালের ২৬ নভেম্বর ভারত মহাসাগর থেকে মালয়েশিয়ার পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আলবেডোক আটক করে সোমালিয়ার জলদস্যুরা। তখন জাহাজটিতে থাকা ২২ কর্মকর্তা এবং ক্রুকে জিম্মি করা হয়। ওই ২২ জনের মধ্যে ছিলেন ৭ বাংলাদেশি, ৭ জন পাকিস্তানি, ৬ জন শ্রীলঙ্কান ও একজন করে ভারতীয় এবং ইরানি নাগরিক। তাদের সবাই মুক্তিপণ দিয়ে দীর্ঘ সময়পর মুক্ত হয়েছিলেন।
কেএসআরএম গ্রুপের আরেকটি জাহাজ এমভি জাহান মনি মুক্তিপণ দিয়ে সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবল থেকে ছাড়া পায় ১০০ দিন পর। জিম্মি হওয়ার আট মাস পরও সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্ত হওয়ার ঘটনার সাক্ষী আছেন দুই বাংলাদেশি নাবিক। তারা হলেন নাবিক জাফর ইকবাল ও গিয়াসউদ্দিন আজম খান। তারা আটক হওয়া ‘এমভি মারিয়া মার্গারেট’ নামের জার্মান পতাকাবাহী জাহাজে কর্মরত ছিলেন।
জেএন/এমআর