মার্কিন উড়োজাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোয়িংয়ের জন্য কাজ করছিলেন। উড়োজাহাজের ভেতরের দেয়ালের উপাদান তৈরিতে কাজ করতে গিয়ে একদিন তাঁর মনে হলো, ‘আমি এখানে কী করছি! আমার সব গবেষণা, উদ্ভাবন তো বিদেশে চলে যাচ্ছে, এদের কাজে লাগছে। আমার দেশের কাজে তো লাগছে না!’
এরপর যুক্তরাষ্ট্রে সর্বোচ্চ সুযোগ–সুবিধা ছেড়ে তিনি দেশে ফিরে এলেন। বানালেন পলিথিনের বিকল্প পাটের তৈরি পরিবেশবান্ধব সোনালি ব্যাগ। বানালেন পাটের তৈরি ঢেউটিন, পাট দিয়ে হেলমেট, টাইলস, চিংড়ির খোসা দিয়ে বানিয়েছেন প্রাকৃতিক প্রিজারভেটিভ। ১৭টি বই এবং একটি পেটেন্টসহ ৬০০ টির বেশি প্রকাশনার লেখক ও সহ–লেখক তিনি।
তিনি মানিকগঞ্জের সন্তান বিজ্ঞানী ড. মোবারক আহমদ খান। এবার দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হয়েছেন। ড. মোবারক আহমদ খানের স্বাধীনতা পদক প্রাপ্তিতে তার নিজ জেলা মানিকগঞ্জের সর্বমহলে বইছে আনন্দের জোয়ার।
পলিথিনের বিকল্প পাটের পলিমার ব্যাগের উদ্ভাবক ড. মোবারক আহমদ খান এই অর্জনের কৃতিত্ব পাট নিয়ে তাঁর গবেষণার ক্ষেত্র তৈরি করা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, শিক্ষার্থী ও সহকর্মীদের উৎসর্গ করেছেন।
১৯৫৮ সালের ৩১ জানুয়ারি মানিকগঞ্জ শহরের হিজুলীতে (শিববাড়ি) ড. মোবারক আহমদ খানের জন্ম। তাঁর বাবা মুহাম্মদ মুর্শিদ খান ছিলেন মানিকগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং মা নুরজাহান বেগম ছিলেন গৃহিণী।
১৯৮৭ সালে বিয়ে করেন জাহানারা বেগমকে। ছেলে শওক মুনতাহা মুর্শিদ খান, মেয়ে আরশি মাওয়ান মুর্শিদ খান। স্ত্রী অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে মহাব্যবস্থাপক হিসেবে অবসর নিয়েছেন। ছেলে জার্মানিতে মিডিয়া ইঞ্জিনিয়ারিং এবং মেয়ে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে বিবিএ পড়ছেন।
মোবারক আহমদের হাতেখড়ি হয় মানিকগঞ্জের দৌলতপুর পিএস স্কুলে। ১৯৭৩ সালে মানিকগঞ্জ মডেল হাইস্কুল থেকে মেট্রিক, এরপর সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন।
১৯৯১ সালে তিনি পলিমার এবং তেজস্ক্রিয় রসায়নে উচ্চতর ডিগ্রি নেন। জার্মানি, জাপান এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে পোস্ট–ডক্টরাল সম্পন্ন করেছেন।
এই বিজ্ঞানী গণমাধ্যমের কাছে তুলে ধরেন তাঁর অতীত, এযাবৎকালের প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার কথা।
মোবারক আহমদ বলেন, ‘বরাবরই ছিলাম কৌতূহলী; নতুন কিছু তৈরির জন্য উন্মুখ। তখন আমি চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। ক্লাসে এক শিক্ষক বললেন, পানিতে কেরোসিন ঢেলে দিলে কিন্তু আগুন জ্বলে। বাড়ি এসেই স্যারের কথা মতো পরীক্ষা চালালাম। আগুনে চোখের পাপড়ি পুড়ে গেল! অল্পের জন্য মুখটা বেঁচে গেল! বিজ্ঞানী হব বলেই নবম শ্রেণিতে বিজ্ঞান নিয়েছিলাম।’
‘সরকারি দেবেন্দ্র কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময় কলেজে বিজ্ঞান ক্লাব “বিজ্ঞান মুকুট” গড়েছিলাম। ১৯৭৪ সালে ঢাকা কলেজে বিজ্ঞান মেলায় অংশ নিয়ে পুরস্কার পাই। যা আমার অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল।’ বলেন মোবারক আহমদ।
ড. মোবারক আহমদের এই অর্জনে মানিকগঞ্জ সরকারি দেবেন্দ্র কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘পাট নিয়ে গবেষণায় তাঁর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি স্বাধীনতা পুরস্কার। তাঁর এ পুরস্কার অর্জনে দেবেন্দ্র কলেজ সম্মানিতবোধ করছে।’
ড. মোবারক আহমদ খান বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে আমরা যেটুকু আবিষ্কার করেছি, এ দেশের উপাদান দিয়ে। তা বিশ্ব বাজারে পুরোপুরি বাস্তবায়নের জন্য কিছু সময় লাগবে। সোনালি ব্যাগ প্রায় ১৫৮টি দেশে স্বীকৃত। আমরা উদ্ভাবন করেছি; তা বিপণনের দায়িত্ব সরকারের।’
তিনি বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার এই প্রকল্পে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন, যা সামনের জুলাই মাসে পাব। আমার ক্ষেত্রে সরকার অনেক ইনভেস্ট করেছেন। এ সম্মাননা প্রাপ্তিতে আমার পিতা–মাতার সবচেয়ে বেশি ভূমিকা। এরপর কৃতজ্ঞতা আমার সহধর্মিণীর। তিনি সব সময় আমাকে সাপোর্ট করেছেন। এ প্রাপ্তির সবচেয়ে মধ্যমণি আমার ছাত্র–ছাত্রী ও সহকর্মী, যারা আমার রিসার্চে এ পর্যন্ত সহযোগিতা করেছেন।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পাট নিয়ে আমার প্রত্যাশা আকাশচুম্বী। বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই।’
ড. মোবারক আহমদ আরও বলেন, ‘আমি মানিকগঞ্জের সন্তান। মানিকগঞ্জ নিয়ে বেশ গর্ব বোধ করি। তবে মানিকগঞ্জবাসী এখনো শিক্ষায় অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এ জেলায় কারিগরি ও ব্যবহারযোগ্য উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা প্রয়োজন। এ বিষয়ে (আমার পাশের গ্রামের বাসিন্দা) ড. অমর্ত্য সেন স্যারের সঙ্গেও কথা হয়েছিল। মানিকগঞ্জের বিভিন্ন মহলের উচ্চতর নীতি নির্ধারকদের অনুরোধ করব, শিক্ষাক্ষেত্র–প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা। আমি আমার সাধ্যমতো পাশে থাকব।’
তিনি পাট ভালোবাসেন। বলেন, ‘আমি যেখানেই যাই, পাট নিয়েই চিন্তা করি। এইটা তো একান্তই আমাদের।’
উল্লেখ্য, ড. মোবারক ১৯৯০ সালে অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ে আইএইএ ফেলো, ১৯৯৫ এবং ২০১৪ সালে জার্মানির বার্লিনের টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি এবং জার্মানির ব্রেমেনের জ্যাকব ইউনিভার্সিটিতে ডাড ফেলো ছিলেন। ১৯৯৭ সালে জাপানের মাৎসুমি ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন এবং ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির ভিজিটিং প্রফেসর ছিলেন। ২০০৩,২০০৫, ২০০৭,২০১০ এবং ২০১৪ সালে তিনি ফ্রাউনহোফার ইনস্টিটিউট ফর অ্যাপ্লাইড পলিমার রিসার্চ এবং ইউনিভার্সিটি অব ক্যাসেল, জার্মানিতে আলেক্সান্ডার ভন হাম্বোল্ট ফেলো (এভিএইচ) ছিলেন।
ভৌত বিজ্ঞানের ওপর তাঁর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১০ সালে স্বর্ণপদক, ২০১৬ সালে জাতীয় পাট পুরস্কার ও ২০১৭ সালে ফেডারেশন অব এশিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটি পুরস্কারে ভূষিত ড. মোবারক আহমদ।
জেএন/এমআর