মাদক কারবার চালিয়ে ফুলেফেঁপে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক তারা। বিভিন্ন ব্যাংকে নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকা জমানো ছাড়াও প্রাসাদোপম বাড়ি গড়েছেন তাদের কেউ কেউ। ২০২০ সালের পর থেকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কাছে থাকা ৩৫টি মামলার তদন্ত করে মাদক সিন্ডিকেটের হাতে ১৭৮ কোটি ৪৪ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদের খোঁজ মিলেছে।
পাওয়া গেছে ১২ ডনের সন্ধানও। তাদের মধ্যে রয়েছেন কক্সবাজার-৪ আসনের সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদির আপন দুই ভাই আবদুস শুক্কুর ও আমিনুর রহমান। মাদকের কারবার করে তাদের জমিজমা, বাড়ি-গাড়িসহ বিপুল সম্পদ গড়ে তোলার তথ্যও উঠে এসেছে সিআইডির অনুসন্ধানে।
দীর্ঘ তদন্তের পর ১০ গডফাদারের নাম-পরিচয় জানায় সিআইডি। তারা হলেন– কক্সবাজারের টেকনাফের নুরুল হক ভুট্টো, শফিক আলম ওরফে শফিক, নুরুল কবির, সিদ্দিক আহমেদ ও মো. ফজর আলী; চট্টগ্রামের শফিক আলম ওরফে শফিক ওরফে শফি, পাবনার শাহীন আলম, খুলনার শাহজাহান হাওলাদার, ঢাকার আদাবরের নুরুল ইসলাম ও টঙ্গী পূর্ব থানার পারুল।
টেকনাফে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বদির দুই ভাই শুক্কুর ও আমিনুর এলাকায় অবস্থান করছেন। মাদক কারবার করে অর্থবিত্তের মালিক হওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে একাধিকবার ফোন করা হলেও তাদের পাওয়া যায়নি।
২০১৪ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের করা এক তালিকায় বদি এবং তাঁর ভাই-বেয়াই, মামা-ভাগনে মিলিয়ে ১০ জনের নাম আসে। ২০০২ সাল থেকে টেকনাফ পৌরসভার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে আসার পর ২০০৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দুই মেয়াদে কক্সবাজার-৪ আসনের এমপি ছিলেন আবদুর রহমান বদি। বর্তমানে ওই আসনের এমপি বদির স্ত্রী শাহীন আক্তার।
২০১৮ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাদকবিরোধী অভিযানের মধ্যে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন বদির বেয়াই আক্তার কামাল। তিনি টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ছিলেন। তার বিরুদ্ধে মানব পাচারের দুটি এবং মাদক পাচারের তিনটি মামলা ছিল।
সিআইডির তদন্তে মাদকের ‘গডফাদার’ হিসেবে বদির যে দুই ভাইয়ের নাম এসেছে তারা ২০১৯ সালে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। ওই সময় টেকনাফে মাদক কারবারিদের আত্মসমর্পণের সুযোগ দিয়েছিল সরকার। দুই ধাপে শুক্কুর, আমিনুরসহ ১২২ জন আত্মসমর্পণ করেন।
গতকাল বুধবার সিআইডি কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত মহাপুলিশ পরিদর্শক ও সিআইডিপ্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, ২০২০ সালের পর থেকে ৩৫টি মাদক মামলার তদন্তে নামে সিআইডি। এসব মামলায় নাম আসা ‘গডফাদারদের’ সম্পদের যে হিসাব পাওয়া গেছে, তার মোট পরিমাণ প্রায় ১৭৮ কোটি ৪৪ লাখ টাকা।
৩৫টির মধ্যে তিনটি মামলার ‘গডফাদারদের’ ৯ দশমিক ১৪ একর জমি এবং ৮ কোটি টাকা দামের দুটি বাড়ি আদালতের নির্দেশে ক্রোক করা হয়েছে। মানি লন্ডারিং মামলায় ব্যাংকে তাদের গচ্ছিত প্রায় ১ কোটি টাকাও ‘ফ্রিজ’ করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রায় ৩৭ কোটি টাকা মূল্যের আরও ৩৫ একর জমি, ১২টি বাড়ি ও একটি গাড়ি ক্রোকের প্রক্রিয়া চলছে।
তিনি বলেন, সিআইডি প্রথমে মাদক সম্পৃক্ত মানি লন্ডারিং মামলার তদন্তে গভীরে প্রবেশ করে। পরে মাদক ব্যবসায়ী ও গডফাদারদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে এবং তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক ও ব্যাংকে থাকা অর্থ ফ্রিজ করা হয়।
পুলিশ সদরদপ্তরের তথ্য উদ্ধৃত করে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৮০ হাজার মাদক মামলা হয়। ২০২১ সালে সারাদেশে ৭৯ হাজার ৬৭৫টি, ২০২২ সালে ৮২ হাজার ৬৭২টি এবং ২০২৩ সালে ৭৬ হাজার ৪২৩টি মাদক মামলা হয়েছে।
সিআইডি-প্রধান বলেন, দেশের ৬৪ জেলায় যেসব মাদক মামলা হয়, তাতে শুধু মাদক বহনকারীদের গ্রেপ্তার করা হয়। গডফাদাররা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। এখন পর্যন্ত ১০টি মামলায় ১২২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
মাদক মামলার তদন্ত করতে গিয়ে সিআইডি বদি বা তাঁর ভাইয়ের মাদক ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে কিনা– এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মাদক মামলায় অর্থ পাচার-সংক্রান্ত বিষয়ে তদন্ত করতে গিয়ে টেকনাফের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির দুই ভাই আমিনুর রহমান ও আবদুস শুক্কুরের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছি। বদির বিরুদ্ধেও যদি আমরা সাক্ষ্য-প্রমাণ পাই, তাহলে ছাড় দেওয়া হবে না। কক্সবাজারে পর্যায়ক্রমে মাদকের গডফাদারদের আইনের আওতায় আনা হবে। মাদক ব্যবসায় যারা অবৈধভাবে সম্পদ ও অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন, তাদের অবৈধ সম্পদ আইনি প্রক্রিয়ায় সরকারি কোষাগারে চলে যাবে।
রাঘববোয়ালদের যত সম্পদ
মাদক কারবারিদের মধ্যে এক রাঘববোয়াল হচ্ছেন নুরুল হক ভুট্টো। এখন পর্যন্ত তাঁর ৩ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের খোঁজ মিলেছে। আরেক বড় কারবারি হলেন চট্টগ্রামের খুলশীর শফিক আলম। মাদক কারবারের মাধ্যমে ৭০০ শতাংশ জমি কিনেছেন তিনি। এই জমির দলিল মূল্য ৫ কোটি ১১ লাখ টাকা। যদিও বাস্তবে এই জমির মূল আরও অনেক বেশি। সব মিলিয়ে প্রায় ৪০ কোটি ১৪ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক শফিক।
আরেক রাঘববোয়াল হলেন চট্টগ্রামের খুলশীর শাহজাহান হাওলাদার। তাঁর আড়াই কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ রয়েছে। মাদক গডফাদারের তালিকায় রয়েছেন শাহীন আলম। মাদক কারবার চালিয়ে ৬ কোটি ২০ লাখ টাকা অবৈধভাবে অর্জন করেছেন। এ ছাড়া তাঁর একটি বাড়ি ও ১৯২ শতাংশ জমি আছে। এই তালিকায় আছেন টেকনাফের হ্নীলার নুরুল কবির। তাঁর অবৈধ সম্পদের পরিমাণ ১২ কোটি টাকা।
টেকনাফে রয়েছে তাঁর সুরম্য ডুপ্লেক্স বাড়ি, ইটভাটা ও পোলট্রি খামার। একইভাবে মাদক কারবারে বিত্তের মালিক হয়েছেন কক্সবাজারের সিদ্দিক আহমেদ। তাঁর অবৈধ সম্পদ ১ কোটি ৫০ লাখ টাকার। এ ছাড়া ৪৮ শতাংশ জমি ও একটি বহুতল ভবন রয়েছে তাঁর। মাদকের আরেক বড় কারবারি হলেন নুরুল ইসলাম। তাঁর অবৈধ সম্পদের পরিমাণ ১৩ কোটি টাকা। ঢাকার তাঁর চারিট বাড়ি রয়েছে।
এই তালিকায় আছেন গাজীপুরের টঙ্গীর এরশাদনগরের পারুল। তাঁর ১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা মূল্যের অবৈধ সম্পদ আছে। টঙ্গীতে তাঁর একটি বাড়ি ও ১৮ দশমিক ৬৫ শতাংশ জমি রয়েছে। মাদকের বড় কারবারিদের মধ্যে আছেন টেকনাফের ফজর আলী। তাঁর অবৈধ সম্পদের পরিমাণ ১ কোটি ৮০ লাখ টাকার।