নানা জল্পনা-কল্পনার পর অবশেষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জাতীয় কমিটির সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইউনুছকে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে সরকার। যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার এই পদে নিয়োগ পাওয়া তৃতীয় রাজনৈতিক ব্যক্তি তিনি। বর্তমান চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষের মেয়াদ শেষ হতে যাচ্ছে আজ।
বুধবার (২৪ এপ্রিল) রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় চুক্তি ও বৈদেশিক নিয়োগ শাখার উপসচিব ভাস্কর দেবনাথ বাপ্পি স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, ‘চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন, ২০১৮ এর খারা-৭ অনুযায়ী জনাব মোহাম্মদ ইউনুছ, পিতা: মরহম নুর হোসেন-কে অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের সাথে কর্ম-সম্পর্ক পরিত্যাগের শর্তে যোগদানের তারিখ থেকে পরবর্তী ৩ (তিন) বছর মেয়াদে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এর চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ প্রদান করা হলো। এই নিয়োগের অন্যান্য শর্ত অনুমোদিত চুক্তিপত্র দ্বারা নির্ধারিত হবে।’
সাম্প্রতিক সময়ে সিডিএ চেয়ারম্যান হিসেবে বেশ কয়েকজনের নাম শোনা যাচ্ছিল। মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি অ্যাডভোকেট ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান ছাড়াও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজনের নামও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনায় আসছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইউনুছের ওপরই আস্থা রাখলো সরকার।
এর আগে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি জহিরুল আলম দোভাষ ২০১৯ সালের ১৮ এপ্রিল প্রথম দফায় দুই বছরের জন্য সিডিএ চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পান। পরে ২০২১ সালের ২৪ এপ্রিল থেকে আবারও পরবর্তী তিন বছরের জন্য তাকে একই পদে নিয়োগ দেয় সরকার। তারও আগে প্রথম রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে নিয়োগ পেয়ে ২০০৯ সালের ২৩ এপ্রিল থেকে ছয় দফায় টানা ১০ বছর সিডিএ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছিলেন বর্তমান সংসদ সদস্য শিল্পপতি আবদুচ ছালাম।
এক নজরে বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউনুছ
১৯৫৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ইউনুছ। হাটহাজারীর নুর আলী মিয়ার হাট ফরহাদাবাদ গ্রামের হিম্মত মুহুরী বাড়ীর মরহুম নুর হোসেনের সন্তান তিনি। তাঁর বাবা ছিলেন বাংলাদেশ রেলওয়ের সাবেক উচ্চতর হিসাব কর্মকর্তা। তিনি চট্টগ্রাম কারাগার থেকে বি.কম পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ডিগ্রি পাস করেন।
ছাত্রলীগের স্কুল সভাপতি থেকে নগর সভাপতি পর্যন্ত হয়েছেন মো. ইউনুছ। এ বীর মুক্তিযোদ্ধা ১৯৬৮ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল হাই স্কুল ছাত্রলীগ সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা সর্বদলীয় মাধ্যমিক স্কুল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি ছিলেন। ১৯৭০ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত চট্টগ্রাম শহর ছাত্রলীগের সহসাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২-৭৩ সালে চট্টগ্রাম শহর ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত দুই মেয়াদে চট্টগ্রাম শহর ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৭৭ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত চট্টগ্রাম কারাগারে বন্দি অবস্থায় চট্টগ্রাম শহর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৮০ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সাবেক মেয়র আজম নাছির উদ্দিন।
এরপর ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত দুইবার বাংলাদেশ ছাত্রলীগ জাতীয় কার্যকরী কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটি আন্তর্জাতিক বিষয়ক সহ সম্পাদক হন। ১৯৮৮ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ কার্যকরী কমিটির সদস্য ছিলেন।
জাতীর মুক্তির সংগ্রামে ১৯৬৯ সালে গ্রেপ্তার হয়ে ১৫ দিন কারাগারে ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউনুছ। ১৯৭০ সালে পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি বাতিলের আন্দোলনে যুক্ত থেকে পাকিস্তান সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালতে ৯ মাস সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করেন।
১৯৭৬ সালে ‘বিশেষ সামরিক আদালত- ৪’ এ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলায় ১২ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৮০ সালের ১ এপ্রিল পর্যন্ত চট্টগ্রাম কারাগারে বন্দিজীবন কাটান। চার বছরের কারাজীবনে দুবছর কাটিয়েছেন কনডেম সেলে।
তিনি ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঐতিহাসিক লালদিঘীর ময়দানে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভায় পাকিস্তানি পতাকা আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেন ইউনুছ। পরদিন ৩ মার্চ বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে চট্টগ্রামের রাজপথ প্রদক্ষিণ করেন।
২৭ মার্চ পাক নৌ-কমান্ডোর সঙ্গে চট্টগ্রাম শহরে প্রথম সংঘর্ষ এবং রাইফেলসহ গ্রেপ্তার হন তিনি। ২ মাস ৬ দিন ধরে শারীরিক নির্যাতন সহ্য করে চট্টগ্রাম কারাগার থেকে পালিয়ে ভারত পাড়ি দেন। ভারতের উত্তর প্রদেশ দেরাদুন তানদুয়ায় ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমি থেকে স্বাধীনতাযুদ্ধের সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন ইউনুছ।
এদিকে জিয়াউর রহমানের সামরিক জান্তা আমলে ১৯৭৬ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধ যুদ্ধ করতে গিয়ে ১২ সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে গোয়েন্দা সংস্থার হাতে গ্রেপ্তার হন। এরপর তাঁকে ঢাকা সেনানিবাসে ৯ দিন, কুমিল্লা সেনানিবাসে ৩ দিন এবং চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ১ মাস ২৮ দিন শারীরিক নির্যাতন করে চট্টগ্রাম কারাগারে পাঠানো হয়।
১৯৮০ সালে কারাগার থেকে মুক্তির পর একাধিকবার দিল্লি যান তিনি। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সঙ্গে তিনি দিল্লির পানদার রোডের বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন। এরপর দেশে ফিরে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এতে সার্বিক নেতৃত্বে ছিলেন ডা. এসএ মালেক।
শেখ হাসিনা স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ১৯৮১ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত কর্মী হিসেবে সবসময় সঙ্গে ছিলেন। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশে পরিকল্পিত আক্রমণের সময় সার্বক্ষণিক সঙ্গে ছিলেন তিনি।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটির সদস্য মো. ইউনুছ চট্টগ্রাম মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা পরিষদের মহাসচিব এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধ যোদ্ধা ফোরাম ‘৭৫ এর আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের ১৮ এপ্রিল প্রথম দফায় দুই বছরের জন্য সিডিএ চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি জহিরুল আলম দোভাষ। পরে ২০২১ সালের ২৪ এপ্রিল থেকে আবারও পরবর্তী তিন বছরের জন্য তাকে একই পদে নিয়োগ দেয় সরকার।
জেএন/এমআর