চট্টগ্রাম বন্দর অপারেশনে যুক্ত হচ্ছে আরও ছয়টি লাইটার জেটি। পতেঙ্গা লালদিয়ার চরের পাশে নিজেদের জায়গায় লাইটার জেটিগুলো করতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এসব জেটি অপারেশনে ঠিকাদার নিয়োগের কার্যক্রমও শেষ পর্যায়ে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লাইটার জেটি চালু হলে চট্টগ্রাম বন্দরের গতিশীলতা যেমন বাড়বে তেমনি সম্প্রসারণ হবে ব্যবসা-বাণিজ্যের। বিশেষ করে এসব জেটি ব্যবহার করে বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা সুফল পাবেন। এতে বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারে আরও বেশি আগ্রহী হবেন।
চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক বলেন, ‘লালদিয়া চরের পাশে বন্দরের নিজস্ব জায়গায় নতুন করে ছয়টি লাইটার জেটি করা হচ্ছে। ডেভেলপ করা হচ্ছে পুরো জায়গাটি। এরই মধ্যে পুরো ইয়ার্ড নির্মাণ সম্পূর্ণ হয়েছে। যারা লাইটার জেটি অপারেশনের জন্য মনোনীত হবেন, তারা আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি সংযোজন করে তাদের অপারেশন শুরু করবেন।’
তিনি বলেন, ‘এরই মধ্যে লাইটার জেটি নির্মাণের জন্য টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। ছয়টি জেটির জন্য আলাদা আলাদা দরপত্র জমা হয়েছে। এর মধ্যে যাচাই-বাছাই শেষে সর্বোচ্চ দরদাতা ছয় প্রতিষ্ঠানকে মনোনীত করার কার্যক্রম প্রায় শেষ পর্যায়ে।’
বন্দর সূত্রে জানা যায়, বিমানবন্দর সড়কের পতেঙ্গা ইনকনট্রেড কনটেইনার ডিপোর পেছনে লালদিয়ার চরের উদ্ধার করা জায়গার পাশে বন্দরের নিজস্ব ১৯ একর জায়গা রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১৩ একর জায়গায় ছয়টি লাইটার জেটির কার্যক্রম শুরু করা হবে। এর মধ্যে বন্দর কর্তৃপক্ষের ডাকা দরপত্রে ছয়টি প্রতিষ্ঠানকে এরই মধ্যে সর্বোচ্চ দরদাতা নির্ধারণ করা হয়েছে।
ব্লক নম্বর-১ এর জন্য ৬ কোটি ৫ হাজার টাকায় ওমেরা ফুয়েলস লিমিটেড, ব্লক নম্বর-২ এর জন্য ৬ কোটি ৮ হাজার টাকায় ইস্ট কোয়েস্ট ট্রেডিং (প্রা.) লিমিটেড, ব্লক নম্বর-৩ এর জন্য ৬ কোটি ৭৩ লাখ টাকায় এস এস ট্রেডিং, ব্লক নম্বর-৪ এর জন্য ৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকায় শাহ সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ, একই দরে ব্লক নম্বর-৫ এর জন্য জিপিএইচ ইস্পাত এবং ব্লক নম্বর-৬ এর জন্য সর্বোচ্চ ৭ কোটি ১৩ লাখ টাকায় এন মোহাম্মদ ট্রেডিং করপোরেশনকে মনোনীত করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে ১ ও ২ নম্বর ব্লকে পেট্রোলিয়াম জ্বালানি খালাসের জেটি হবে। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো স্ক্র্যাপ, সিমেন্ট ক্লিংকারসহ প্রতিষ্ঠানগুলোর আমদানি করা পণ্য খালাস করবে।
বন্দর সূত্র জানায়, প্রতিটি লাইটার জেটির জন্য প্রায় ২ দশমিক ৫ একর জায়গা বরাদ্দ রাখা রয়েছে। এর মধ্যে প্রত্যেক জেটির জন্য নদীর মুখে ৭১ মিটার জায়গা রাখা হয়েছে। যেখানে পন্টুন স্থাপন করে জাহাজের পণ্য খালাস করবে ইজারা পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো। পাশাপাশি পণ্য খালাস করতে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও ইজারাদার প্রতিষ্ঠানকে সংযোজন করতে হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ছয়টি জেটি ইজারা দেওয়ার জন্য এরই মধ্যে ছয় প্রতিষ্ঠানকে মনোনীত করা হয়েছে। এর মধ্যে দুটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে সরকারের এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর নিকটজন। তাছাড়া দুটি জেটিতে সর্বোচ্চ দরদাতা আলাদা প্রতিষ্ঠান হলেও তাদের দর হচ্ছে একই। প্রাথমিকভাবে জেটিগুলো প্রতিষ্ঠানগুলোকে ১০ বছরের জন্য ইজারা দেওয়া হচ্ছে।
জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে আইকনিক প্রজেক্ট বে-টার্মিনাল প্রকল্প হাতে নেওয়ার আগে থেকে লালদিয়া মাল্টিপারপাস টার্মিনাল করার উদ্যোগ নেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। ২০১৩ সালের লালদিয়া টার্মিনাল প্রকল্পটি মন্ত্রিসভা কমিটি অনুমোদন দিলেও প্রকল্প বাস্তবায়নে নানান জটিলতার সম্মুখীন হয় বন্দর। ওই জায়গা দীর্ঘদিনের পুরোনো অবৈধ বসতি ছিল বড় প্রতিবন্ধক। তবে ২০২১ সালের প্রথম দিকে লালদিয়া চরের ১৭শ অবৈধ বসতি উচ্ছেদ করে পুরো জায়গা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ।
পাশাপাশি লালদিয়া চরের পাশে কর্ণফুলী নদী তীরের ১৯ একর খালি জায়গা ভরাট করে ইয়ার্ড নির্মাণ করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এই জায়গায় এরই মধ্যে কাস্টমসের এফ ও রামেজ ডিভিশনের অফিস, মেরিন ফিশারিজের সার্ভিল্যান্স চেকপোস্ট, রেড ক্রিসেন্টের অফিস কাম জেটিসহ বন্দরের একটি স্থাপনা রয়েছে।
বন্দর কর্তৃপক্ষের উপ-ব্যবস্থাপক (ভূমি) মুহাম্মদ শিহাব উদ্দিন বলেন, ‘ইনকনট্রেড অফডক ডিপোর পেছনে বন্দরের নিজস্ব ১৯ একর জায়গায় ইয়ার্ড নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের অফিস রয়েছে। পাশাপাশি ইয়ার্ড অংশে ছয়টি লাইটারেজ জেটি হচ্ছে। যাদের ইজারা দেওয়া হবে বরাদ্দ প্রাপ্তির ছয় মাসের মধ্যে তারা অপারেশনে যাবে।’
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ওমর হাজ্জাজ বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরে লাইটারেজ জাহাজ খালাসের জন্য পর্যাপ্ত সুবিধা এতদিন ছিল না। যেসব লাইটারেজ খালাস হচ্ছে, সেগুলোও মান্ধাতা আমলের মতোই। তেমন সুযোগ সুবিধা নেই। আমরা একবিংশ শতাব্দীতে এলেও আমাদের বন্দরে এখনো আধুনিক লাইটার জেটি নেই। এখন বন্দর কর্তৃপক্ষ ছয়টি আধুনিক লাইটার জেটি করছে, এটি ইতিবাচক একটি উদ্যোগ।’
তিনি বলেন, ‘লাইটার জাহাজ দিয়ে দ্রুত আমদানি পণ্য খালাস করা গেলে বিদেশগামী মাদার ভ্যাসেলগুলোও নির্দিষ্ট সময়ে খালাস করা সম্ভব হবে। এতে পণ্যের আমদানি ব্যয় কমে যাবে। যার সুফল ভোগ করবে সাধারণ মানুষ। পাশাপাশি বিদেশে আমাদের বন্দরের ভাবমূর্তিও বাড়বে। তাছাড়া যারা এসব লাইটার জেটিতে বিনিয়োগ করছেন, তারাও দ্রুত তাদের পণ্য খালাস করতে পারবে। এতে অন্য বেসরকারি উদ্যোক্তারাও এ ধরনের জেটি অপারেশনে আগ্রহী হয়ে উঠবেন।’
২০১৮ সালের কর্ণফুলী নদীর সদরঘাট এলাকায় পাঁচটি লাইটার জেটি নির্মাণ করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এগুলো বিএসএম গ্রুপ, বিএসআরএম, কেএসআরএম, আবুল খায়ের স্টিল এবং কনফিডেন্স সিমেন্ট লিমিটেডকে বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর মধ্যে বিএসএম গ্রুপ তাদের জেটি দিয়ে খাদ্যশস্য, বিএসআরএম, কেএসআরএম ও আবুল খায়ের স্টিলকে স্ক্র্যাপ এবং কনফিডেন্স সিমেন্ট লিমিটেডকে সিমেন্ট কাঁচামাল খালাসের জন্য ইজারা দেওয়া হয়।
জেএন/এমআর