ফাঁকা মাঠের মধ্যে আলিশান বাংলো। যার আশপাশে নেই কোনো বসতি। কি নেই সেখানে। প্রায় ২৫ বিঘা জমির ওপর এই বাংলোর মালিক ঝিনাইদহ-৪ আসনের (কালীগঞ্জ) সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যার মাস্টারমাইন্ড আক্তারুজ্জামান শাহীনের। আর এই বন্ধুর বাংলোতে নাকি মাঝেমধ্যেই যেতেন সংসদ সদস্য আনার।
বৃহস্পতিবার (২৩ মে) বিকেলে গিয়ে দেখা যায়, কোটচাঁদপুর উপজেলার এলাঙ্গী গ্রাম থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে ফাঁকা মাঠের মধ্যে সুবিশাল আলিশান বাংলোবাড়ি। বাংলোর চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া। বাইরে থেকে কেউ ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে না। গ্রামের বা অপরিচিত কারও ভেতরে প্রবেশ করার সুযোগ নেই। সেখানে গিয়ে বাংলোবাড়ির মেইন গেট বন্ধ পাওয়া যায়। পরে দুর্গম মাঠের আখ খেতের মধ্য দিয়ে বাংলো বাড়ির কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করা হয়।
সেখানে গিয়ে দেখা যায়, এই বাংলা বাড়িতে কি নেই। কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা ২৫ বিঘা জমিতে রয়েছে বিশাল পুকুর। একটি কাচ দিয়ে ঘেরা ডুপ্লেক্স বাড়ি ও অন্যটি ইট পাথরের। এর সামনে রয়েছে সুইমিং পুল। প্রতি ঘরে রয়েছে এসির সংযোগ। বাংলো বাড়ির নিরাপত্তায় রয়েছে প্রায় শতাধিক সিসি ক্যামেরা। রয়েছে চারটি বিদেশি কুকুর। এ ছাড়া ঘাস কাটার মেশিন ও একটি মাইক্রোবাস রয়েছে সেখানে।
আক্তারুজ্জামান শাহীনের পরিবার থেকে জানা যায়, বাবা আসাদুজ্জামান কাটুর পাঁচ সন্তানের মধ্যে চতুর্থ আক্তারুজ্জামান শাহিন। ১৯৮৫ সালে কোটচাঁদপুর পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও কোটচাঁদপুর কলেজ থেকে ১৯৮৭ সালে এইচএসসি পাস করেন তিনি। এরপর এক বছর বিরতি থেকে চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমি থেকে দুই বছরের কোর্স করেন, এরপর জাহাজে চাকরিতে যোগদান করেন। চাকরির দুই বছর পর আবার মেরিন একাডেমি থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন।
আরও জানা যায়, আমেরিকার (ওপি টিকিট) ফ্রি ভিসা পাওয়ার পর ১৯৯২-৯৩ সালের দিকে আমেরিকা যান আক্তারুজ্জামান শাহীন। এরপর তিনি আমেরিকার নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন।
জানা যায়, জাহাজে চাকরি করার সময়কালেই তিনি ঢাকায় বিয়ে করেন। শাহীনের স্ত্রীর নাম কনক ইসলাম। তাদের সংসারে এক ছেলে ও এক মেয়ে। তারা মা-বাবার সঙ্গে আমেরিকায় থাকেন।
গ্রামের কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ৬ বছর আগে প্রায় ২৫ বিঘা জমির ওপর তৈরি করা হয় এই বাংলোবাড়ি। তারা কখনো ভেতরে প্রবেশ করেননি। তবে মাঠে কাজ করতে গিয়ে কাঁটাতারের ফাঁক দিয়ে দেখেছেন। ওই বাংলোবাড়ির আশপাশে কোনো বসতি নেই। নির্জন স্থানে এই বাড়ি। রাত হলে কাঁটাতারের চারপাশে জ্বলে আলো। কিন্তু ভেতরে কী হচ্ছে কেউ জানতে পারে না। রাতে বড় বড় গাড়ি আসত। অনেকেই সেই গাড়িতে নারী থাকতে দেখেছেন। এমনকি নায়িকারাও মাঝেমধ্যে আসতেন এই বাংলোয়।
এলাঙ্গী গ্রামের আকলিমা খাতুন বলেন, গত জাতীয় ভোটের পর এই বাংলোয় আসেন এমপি আনার। প্রায় তিনি এই বাংলোতে আসতেন। এবার ভোটে পাস করার পর বাংলোতে যাওয়ার সময় গাড়ির ভেতর থেকে হাত বের করে আমাদের শুভেচ্ছা জানান।
মো. শহিদুল ইসলাম নামের এক স্থানীয় বলেন, আমরা মাঠে যাই কাজ করি। জানি যে এটা শাহীনের বাংলোবাড়ি। কখনো ওই বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতে পারিনি। এই মাঠের মধ্যে এমন দামি বাড়ি, এই বাড়িতে কারা থাকে তাও জানি না। তবে এই বাড়িতে মাঝেমধ্যে সাদা-কালো দামি দামি গাড়িতে করে লোক আসত। দিনের বেলা বেশি গাড়ি বাংলোতে প্রবেশ করে না। রাত ১০টার পরে দামি দামি গাড়ি প্রবেশ করে। বাংলোতে যারা কাজ করে তারা কেউ কোটচাঁদপুরের না। অনেক গাড়িতে তিনি নারী থাকতে ও বাংলোর ভেতরে হাঁটাহাঁটি করতে দেখেছেন।
এমপি আনারের আরেক বাল্যবন্ধু গোলাম রসুল জানান, আনার ও আক্তারুজ্জামানের মধ্যে প্রায় ৩০ বছরের সম্পর্ক। তাকে নিয়ে এমপি আনার দুইবার সেখানে গিয়েছেন। গত চার মাস আগেও তিনি গিয়েছেন।
মাস্টারমাইন্ড আক্তারুজ্জামান শাহীনের ভাই ও কোটচাঁদপুর পৌরসভার মেয়র সহিদুজ্জামান সেলিম বলেন, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বা টিভি মিডিয়ায় আমার ভাইয়ের কথা উঠে আসছে। যদি তদন্তে তার নাম আসে তাহলে দেশের প্রচলিত আইনে তার শাস্তি চাই। তবে আমার বিশ্বাস হচ্ছে না যে আমার ভাই এরকম কাজ করতে পারে। শাহীন আগে বাড়িতে আসত। বাংলোবাড়ি করার পর আমাদের বাড়িতে আসে না। আমার পৌরসভার নির্বাচনের পর থেকে খুব কম আসে, আর এলেও ওই বাংলোয় থাকে।
জেএন/এমআর