ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ঝিনাইদহ-৪ আসনের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যা মামলায় গ্রেফতার তিন আসামির আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
রিমান্ডপ্রাপ্তরা হলেন, তানভীর, শিমুল ভূঁইয়া ও সিলিস্তি রহমান।
শুক্রবার দুপুর সোয়া ২টার দিকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তাদের হাজির করা হয়। এ সময় মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তাদের ১০ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার মাহফজুর। শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট দিলরুবা আফরোজ তিথি এ রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এর আগে বৃহস্পতিবার সৈয়দ আমানুল্লাহ, ফয়সাল আলী ও সিলিস্তি রহমানকে এ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়।
ভারতে চিকিৎসা নিতে গিয়ে কলকাতার দমদম বিমানবন্দর লাগোয়া নিউটাউনে রহস্যজনকভাবে খুন হন আনোয়ারুল আজিম আনার। স্নায়ুরোগের চিকিৎসা নিতে তিনি ১২ মে দর্শনা-গেদে সীমান্ত দিয়ে কলকাতা যান। কিন্তু পরদিন থেকেই রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন। মূলত সেদিনই (১৩ মে) তাকে হত্যা করা হয়।
এ ঘটনা প্রকাশ্যে আসে বুধবার। ওইদিনই রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন (২৪) বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
এদিকে বৃহস্পতিবার বেলা ৩টায় ভারতের একটি তদন্তদল ঢাকায় পৌঁছেছে। এদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার পর ডিবি কার্যালয়ে যান ভারতের ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর অফিসার অন্তু কুমার, জয়দীপসহ চারজন। তারা সেখানে আনারের মৃত্যুর ঘটনার নানা দিক নিয়ে ডিবি ওয়ারী বিভাগের সঙ্গে আলোচনা করেন। পরে ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশন হয়ে বিকালে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) সদর দপ্তরে একটি বৈঠক করে। একই সঙ্গে ডিবির কাছে গ্রেফতার থাকা হত্যামামলার আসামিদের সঙ্গেও কথা বলেন তারা। পরে রাত ৯টা ৫০ মিনিটের দিকে ডিবি কার্যালয় থেকে বের হন। তারা এ সময় সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি।
বৈঠক শেষে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মো. হারুন অর রশীদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের কাছে যেসব আসামি আছে তাদের সঙ্গে কলকাতা পুলিশের প্রতিনিধি দল কথা বলেছে। আসামিরা যেসব তথ্য আমাদের কাছে দিয়েছে একই তথ্য তাদেরকে দিয়েছে। আসামিদের বক্তব্য তারা শুনেছেন। পাশাপাশি ওই দেশে যারা গ্রেফতার হয়েছে তাদের মাধ্যমে কলকাতা পুলিশ অভিলম্বে ভুক্তভোগীর ডেডবডির বিভিন্ন অংশ উদ্ধারের চেষ্টা করছেন।
তিনি আরও বলেন, কলকাতা পুলিশের এ টিমটি বেশ কয়েক দিন ঢাকায় থাকবেন। আগামী শনিবার তারা আবার ডিবিতে আসবেন। বাংলাদেশ থেকে একটি টিম কলকাতায় যেতে পারে। তবে কারা যাবেন সেটি এখনো ঠিক হয়নি। এই বিষয়ে সিনিয়ররা সিদ্ধান্ত নেবেন।
ডিবি সূত্র জানায়, ভারতীয় পুলিশ সদস্যরা নিহত আনোয়ারুল আজিমের হত্যাকাণ্ড নিয়ে তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও পরিবারের সঙ্গে কথা বলবেন। তারা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বাংলাদেশে গ্রেফতার তিন আসামিকেও জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। এ ঘটনায় সন্দেহভাজন দুই ভারতীয় নাগরিক গ্রেফতারের বিষয়েও আলোচনা হবে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আমানুল্লাই যে শিমুল, তা জানা ছিল না তদন্তসংশ্লিষ্টদের। সংসদ-সদস্য আনার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শিমুল ভুঁইয়া এবং তানভীর ভূঁইয়াকে আটকের পর তানভীর ডিবিকে জানায়, আমানুল্লাহ তার চাচাতো ভাই। এ সময় দুজনের নামের মিল না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, তারা দুজনই ভুঁইয়া। চরমপন্থি দলের সঙ্গে জড়িতে থাকার কারণে শিমুলের বিরুদ্ধে অনেক মামলা ছিল। তাই পুলিশকে বিভ্রান্ত করার জন্য তিনি তার নাম পরিবর্তন করে সৈয়দ আমানুল্লাহ ধারণ করেন।
ডিবি সূত্র জানায়, আনার হত্যার বেশির ভাগ খুনিই এখন গোয়েন্দাজালে। কৌশলগত কারণে এ মুহূর্তে সবার নাম বলা যাচ্ছে না। হত্যাকাণ্ড কীভাবে ঘটছে, এ বিষয়ে আটক ব্যক্তিরা এরই মধ্যে বিস্তারিত তথ্য দিয়েছেন। তবে হত্যার কারণ সম্পর্কে এখনো বিস্তারিত জানা যায়নি। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, স্বর্ণ চোরাচালান ও হুন্ডি ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে সংসদ-সদস্য আনারের সঙ্গে শাহীনের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। সংসদ-সদস্য সম্ভবত শাহীনের কাছে মোটা অঙ্কের অর্থ পেতেন। সংসদ-সদস্যকে হত্যা করা হলে সেই টাকা দিতে হবে না-এমন ধারণা থেকে পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে।
প্রথমে বাংলাদেশেই হত্যা মিশন সম্পন্ন করতে চাইলেও পরে ওই বৈঠকেই সিদ্ধান্ত হয় কলকাতায় হত্যা করা হবে। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত তিনজনকে আটক করে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তারা হলেন শিমুল ভুঁইয়া ওরফে আমানুল্লাহ, তার ভাই তানভীর ভুঁইয়া ও মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান শাহীনের বান্ধবী সেলেস্তি রহমান। এছাড়া আরও দুজন ভারতে আটক আছেন বলে জানায় ডিবি।
ডিবি জানায়, সংসদ-সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারকে হত্যার পর শরীর খণ্ড খণ্ড করা হয়। হাড় ও মাংস আলাদা করে হলুদের গুঁড়া মিশিয়ে ব্যাগে ভরে ওই বাসা থেকে বের করা হয়। তবে কোথায় এ খণ্ড খণ্ড
মরদেহ ফেলা হয়েছে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
বৃহস্পতিবার বেলা ৩টার দিকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ১৩ মে কলকাতায় বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের বারবার নির্বাচিত সংসদ-সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারকে অত্যন্ত নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। তার লাশ টুকরো টুকরো করে বিভিন্ন জায়গায় ফেলে দেওয়া হয়েছে।
হত্যাকাণ্ড এবং লাশ গুম হয়েছে পশ্চিম কলকাতায়। হত্যাকাণ্ডে জড়িত তিনজন আমাদের আছে আছে। তাদের ভাষ্যমতে, দুই থেকে তিন মাস ধরে সংসদ-সদস্য আনারকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড আক্তারুজ্জামান শাহীনের গুলশান ও বসুন্ধরার দুটি বাসায় একাধিক বৈঠক করে। আনারকে হত্যার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা অন্য যে কারণই থাকুক না কেন, তা বের করা হবে।
ডিএমপির ডিবিপ্রধান মো. হারুন অর রশীদ বলেন, হত্যাকাণ্ডের প্রথম পরিকল্পনা দেশের মাটিতে হলেও পরে গোয়েন্দা পুলিশের ভয়ে দেশের বাইরে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনার পার্ট হিসাবে ২৫ এপ্রিল কলকাতায় একটি বাসা ভাড়া করা হয়। বাসা ভাড়ার অ্যাগ্রিমেন্টে বলা আছে তারা সেখানে ৩০ এপ্রিল উঠবে।
সে অনুযায়ী আক্তারুজ্জামান শাহীন, তার গার্লফ্রেন্ড এবং হত্যাকাণ্ডের মূল সংগঠক আমানুল্লাহ ৩০ এপ্রিল বাংলাদেশ থেকে বিমানে কলকাতায় চলে যান। তারা দুই মাস ধরে লক্ষ রাখছিলেন ভিকটিম কোন সময় কলকাতায় যান। ভিকটিম আগেও অনেকবার কলকাতায় গেছেন। সেখানে অনেকদিন ছিলেনও। ১২ মে ভিকটিম সংসদ-সদস্য আনার কলকাতায় চলে যান এবং বন্ধুর বাসায় ওঠেন। এর পরদিনই তিনি হত্যার শিকার হন।
ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন বলেন, হত্যাকারীরা আগেই জানতে পারেন সংসদ-সদস্য আনার ১২ মে কলকাতা যাবেন। ফলে হত্যার পরিকল্পনা অনুযায়ী ৩০ এপ্রিল কলকাতা গিয়ে আরও দুজন লোক ভাড়া করেন। তাদের মধ্যে একজন জিহাদ ওরফে জাহিদ এবং আরেকজন সিয়াম।
আক্তারুজ্জামান শাহীন ঠিক করেন হত্যাকাণ্ডে কোন গাড়ি ব্যবহার হবে, কারা কারা থাকবে, কাকে কত টাকা দিতে হবে। কলকাতার ওই ভাড়া বাসায় ৫-৬ জনকে রেখে আক্তারুজ্জামান শাহীন ১০ মে বাংলাদেশে চলে আসেন। ঘটনার দিন সংসদ-সদস্য আনার বন্ধুর বাসা থেকে বের হয়ে একটি সাদা গাড়িতে করে ফয়সাল নামের একজন ব্যক্তি কাছে যান। সেখান থেকেই গাড়িতে ওঠেন মূল হত্যাকারী আমানুল্লাহ।
গাড়িটি চালাচ্ছিলেন ভারতীয় নাগরিক রাজা। এই রাজা তাদের নিয়ে ওই বাসায় পৌঁছে দেন। আনার ওই বাসায় যাওয়ার পরপরই মুস্তাফিজ নামের আরেক ব্যক্তি সেখানে যান। জিহাদ ওরফে জাহিদ এবং সিয়াম আগেই বাসার ভেতরে ছিলেন। বাসায় ঢোকার আধা ঘণ্টার মধ্যেই এ নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে। হত্যার আধা ঘণ্টা বা এক ঘণ্টা পরই তাদের মধ্যে একজন বের হয়ে যান। তিনি ভিকটিমের মোবাইল ফোন দিয়ে কিছু মেজেস পাঠান বিভিন্ন লোককে। বিষয়টিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করইে তারা এ মেসেজ পাঠান।
হারুন অর রশীদ বলেন, হত্যাকারীদের পরিকল্পনা ছিল লাশটি এমনভাবে গুম করা হবে যাতে কেউ কোনোদিন খুঁজে না পায়। যে কারণে তারা ভিকটিমের শরীরকে বিভিন্ন পার্টে ভাগ করে ফেলে। হাড়ের সঙ্গে মাংস আলাদা করে ফেলে এবং মাংস সুটকেসে করে মূল হত্যাকারী আমানুল্লাহ ও জাহিদ বা জিহাদ দুজন দুটি ব্রিফকেসে করে পাবলিক টয়লেটের কাছে নিয়ে যান। সেখানে একটি গাড়ি নিয়ে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন সিয়াম। সেখান থকে সিয়াম ও জাহিদ বা জিহাদ লাশের খণ্ডিত অংশ নিয়ে চলে যান। এরপর মূল হত্যাকারী আমানুল্লাহ বাসায় চলে আসেন।
পরদিন আমানুল্লাহ ও আরও দুজন বাকি মাংসগুলোকে পলিথিনে করে সরিয়ে ফেলেন। মাংসগুলো যদি পথে কেউ ধরে, এ ভয়ে হলুদের গুঁড়া মেশায়, যাতে তারা বলতে পারে বাজার থেকে কিনে এনেছে। অর্থাৎ তাদের উদ্দেশ্য ছিল এমনভাবে লাশ গুম করা হবে যেন কেউ কোনোদিন তার অস্তিত্ব না পায়। হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে অপরাধীরা একে একে বাংলাদেশে চলে আসেন।
১৫ মে মূল হত্যাকারী আমানুল্লাহ ও আক্তারুজ্জামান শাহীনের বান্ধবী বাংলাদেশে চলে আসেন। ১৬ মে বাংলাদেশে আসেন মুস্তাফিজ। এভাবে একে একে হত্যাকারীরা যখন বাংলাদেশে চলে আসেন, তখন মূল মাস্টারমাইন্ড আক্তারুজ্জামান শাহীন বাংলাদেশ থেকে ভিস্তা এয়ারলাইন্সের প্রথমে দিল্লি এবং সেখানে দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করে দিল্লি থেকে কাঠমান্ডু যান। সেখান থেকে দুবাই হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান।
ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার আরও বলেন, হত্যাকাণ্ডের পর তারা ভিকটিমের মোবাইল ফোন থেকে বিভিন্ন লোকের কাছে মেসেজ পাঠিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন ভিকটিম এখনো ঠিক আছেন। সর্বশেষ ১৮ মে পাঠানো মেসেজে বলা হয়, ‘আমি দিল্লি যাচ্ছি। সেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হবে, সেখানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যাবে। মন্ত্রিত্ব পাওয়ার বিষয়ে কথা হবে।’
অপরাধীরা অপরাধ করে ডিভাইসের মাধ্যমে অপরাধ তদন্তকারী সংস্থাকে ভিন্নখাতে নেওয়ার চেষ্টা করে। এ কারণে ভিকটিমের মোবাইল ফোনকে বেনাপল, মোজাফফরাবাদসহ বিভিন্ন স্থানে পাঠিয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কী কারণে হত্যাকাণ্ড, সেটি আমরা পরে বের করব। কারা এর সঙ্গে জড়িত, তাদের সবকিছুই আমরা পেয়েছে।
জেএন/এমআর