সাবেক প্রধান বিচারপতি, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক দুই বিচারপতিসহ অন্তত পাঁচ বিচারকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা মামলার বিচার চলছে।
দুর্নীতির অভিযোগে দায়ের করা এসব মামলায় ইতোমধ্যে সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার ১১ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে।
আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি জয়নুল আবেদীন এবং সাবেক বিচারপতি ফজলুল হক দুর্নীতি মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন। এ ছাড়া জেলা জজ পদমর্যাদার আরও দুই বিচারকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলার বিচার চলছে।
সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা
দুর্নীতির মামলায় সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহার ১১ বছরের কারাদণ্ড এবং ৪৫ লাখ টাকা জরিমানা হয়েছে। ২০২১ সালের ৯ নভেম্বর ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪-এর বিচারক শেখ নাজমুল আলম এই রায় দেন।
সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে সাত বছর এবং দুর্নীতি দমন আইনে চার বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। পাশাপাশি ৪৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
২০২০ সালের ১৩ আগস্ট এস কে সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে বিচারকাজ শুরু হয়। ওই বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কে এম ইমরুল কায়েশ মামলাটি ঢাকার বিশেষ জজ-৪-এ বদলির আদেশ দিয়েছিলেন।
২০১৯ সালের ১০ জুলাই দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন বাদী হয়ে ঢাকায় সংস্থাটির সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে মামলা করেন। ওই বছরের ১০ ডিসেম্বর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দুদকের পরিচালক বেনজীর আহমেদ আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন।
সাবেক বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীন
অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীন ও তার ছেলে মো. ফয়সাল আবেদীনের বিরুদ্ধে বিচার চলছে। ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৮-এর বিচারক মো. বদরুল আলম ভূঞা গত ১ এপ্রিল অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিক বিচারকাজ শুরু করেন।
এই মামলায় আজ ৩০ মে সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য রয়েছে। ২০১৯ সালের ২১ জুলাই অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। পরে দুজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের সহকারী পরিচালক গোলাম মাওলা।
অভিযোগে বলা হয়, জয়নুল আবেদীনের মোট সম্পদ ১ কোটি ৩২ লাখ ৩৯ হাজার ১৭৪ টাকা। তার ১৯৮২-৮৩ করবর্ষ থেকে ২০১০-১১ করবর্ষ পর্যন্ত পারিবারিক ও অন্যান্য খাতে ব্যয় হয়েছে ৬৪ লাখ ৭৪ হাজার ৩৯ টাকা। পারিবারিক ও অন্যান্য ব্যয়সহ অর্জিত সম্পদ ১ কোটি ৯৭ লাখ ১৩ হাজার ২১৩ টাকা।
এর বিপরীতে আয়ের উৎস পাওয়া যায় ১ কোটি ৮৭ লাখ ৬৩ হাজার ৩০৪ টাকার। তার আয়ের তুলনায় ৯ লাখ ৪৯ হাজার ৯০৯ টাকা বেশি সম্পদের তথ্য পাওয়া যায়।
সাবেক বিচারপতি ফজলুল হক
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি ফজলুল হকের বিরুদ্ধেও চলছে অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জনের মামলা। ২০০৮ সালের ১৩ এপ্রিল রমনা থানায় এই মামলা করে দুদক। ২০১৬ সালের ১৪ নভেম্বর মামলাটির অভিযোগ গঠন করা হয়।
পরে মামলাটি বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন বিচারপতি ফজলুল হক। ২০১৭ সালের ১৫ মার্চ ওই আবেদন খারিজ করেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল (আপিল অনুমতির আবেদন) করলে ওই বছরের ৩১ জুলাই তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের তিন বিচারপতির বেঞ্চ তাকে আপিল করার অনুমতি দেন।
বিচারক মোতাহার হোসেন, বিদেশে পলাতক
ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৪-এর বিচারক মোতাহার হোসেনের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০২২ সালে মামলা করে দুদক। ওই বছরের ১২ জুন দুদক উপপরিচালক জালাল উদ্দিন আহাম্মদ বাদী হয়ে
ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১-এ মামলা করেন। এজাহারে বলা হয়, বিচারক মো. মোতাহার হোসেন তার নিজ নামে ও স্ত্রী তাসলিমা বেগম ওরফে আরজুমান্দ আরার (মৃত) নামে অর্জিত জমি বা স্থাবর সম্পদের মোট পরিমাণ ৯ দশমিক ৩২৯৯ একর বা ৯৩৪ শতক। যার দালিলিক মূল্য ১৪ লাখ ১৮ হাজার ৯৯৪ টাকা।
স্থাবর সম্পদ ছাড়া মো. মোতাহার হোসেনের নিজ নামে ২৫ লাখ ২৯ হাজার ৭৬১ টাকার অস্থাবর সম্পদ আছে। স্থাবর-অস্থাবর মিলিয়ে তার ৩৯ লাখ ৪৮ হাজার ৭৫৫ টাকার সম্পদসহ মোট ৫৩ লাখ ৮৩ হাজার ৫৫ টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে।
এর মধ্যে ৪১ লাখ ৪৭ হাজার ৪৯০ টাকার সম্পদের বৈধ উৎস পাওয়া গেলেও ১২ লাখ ৩৫ হাজার ৫৬৫ টাকার সম্পদের কোনো বৈধ উৎস পাওয়া যায়নি। এসব সম্পদ তিনি অবৈধভাবে অর্জন করেছেন বলে দুদকের অনুসন্ধানে প্রমাণ হয়েছে। অবৈধ সম্পদ অর্জন করে তা ভোগদখলে রাখার অভিযোগে দুদক মামলাটি করে।
দুদকের তথ্যমতে, ২০১৪ সালের ২০ জানুয়ারি মোতাহার হোসেনের বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। ওই সময়ে তার বিরুদ্ধে বিদেশ ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা জারি করে দুদক। দুদক অনুসন্ধান শুরুর আগেই তিনি মালয়েশিয়া চলে যান। বর্তমানে মামলার বিচার চলছে।
সাবেক জেলা জজ রুহুল আমীন খোন্দকার
সাবেক জেলা জজ রুহুল আমীনের বিরুদ্ধে মামলা: ১ কোটি ৩০ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ ও সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে সাবেক জেলা ও দায়রা জজ মো. রুহুল আমীন খোন্দকারের বিরুদ্ধে ২০২২ সালের ২৪ মার্চ মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১-এ মামলাটি করেন দুদকের সহকারী পরিচালক মানসী বিশ্বাস।
এজাহারে বলা হয়, ১৯৮৩ সালের ২০ এপ্রিল মো. রুহুল আমীন খোন্দকার মুন্সেফ হিসেবে সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন। সর্বশেষ জেলা জজ হিসেবে চাকরিরত অবস্থায় দুর্নীতি ও অসদাচরণের দায়ে ২০১৬ সালের ২৪ অক্টোবর মাসে সরকারি চাকরি (জেলা জজ) থেকে অপসারণ করা হয়। তার স্ত্রী মরিয়ম জামিলা একজন গৃহিণী। তার কোনো আয়কর নথি কিংবা আয়ের কোনো উৎস নেই।
যেখানে দুদক দেখতে পেয়েছে রুহুল আমীন চাকরিরত অবস্থায় তার অবৈধ আয় দ্বারা তার স্ত্রী মরিয়ম জামিলা (১০%) এবং তার ছেলে খোন্দকার তারিক আমিন রনিকে (৫%) পরিচালক এবং নিজেকে আরআরটেক্স ইন্টারন্যাশনালের ১০ শতাংশ শেয়ারহোল্ডার হিসেবে দেখিয়ে কোম্পানি গঠন করেন।
ওই কোম্পানি জয়েন্ট স্টক অ্যান্ড ফার্মের অধিদপ্তর থেকে রেজিস্ট্রেশন করান। এভাবে মোট ৬৯ লাখ ৪৮ হাজার ৪৬৭ টাকার তথ্য গোপনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। অন্যদিকে দুদকের অনুসন্ধানে স্ত্রীসহ পরিবারের সদস্যদের নামে ৯১ লাখ ১১ হাজার ৭৭৭ টাকার অবৈধ সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে।
জেএন/পিআর