যে মায়ের কোলে-পিঠে বড় হয়েছেন তার শরীরে ছেলের ৪৬ কোপ!

অনলাইন ডেস্ক

সোমবার (৩ জুন) তপ্ত দুপুর। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (চমেক) মর্গে পড়ে ছিল পাহাড়তলীর ভেলুয়ারদিঘীর পাড়ে একমাত্র সন্তানের হাতে খুন হওয়া রিনা আক্তার চন্দনার (৩৯) নিথর দেহ। মমতাময়ী এ মায়ের দেহ দেখলে শিউরে উঠবেন যেকেউ। দেহের বিভিন্ন স্থানে ছিল শুধু কোপের দাগ। সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরির সময় পুলিশ গুনে দেখেছে ৪৬টি আঘাত রয়েছে ভুক্তভোগী নারীর দেহে।

- Advertisement -

ঘাতক আর কেউ নন। নাড়িছেঁড়া একমাত্র সন্তান মো. ওমর ফারুকই (২৩) বটি দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করেছেন তাকে। যেই সন্তান ১০ মাস এ মায়ের পেটে ভর করে দুনিয়ায় এসেছিলেন। শত যাতনা সয়ে কোলে-পিঠে বড় করেছেন তাকে। আর্থিক অনটনের মধ্যেও চেষ্টা করেছেন সন্তানকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে। কিন্তু পারেননি। কলেজে পড়ার সময় ওমর হয়ে পড়েন মাদকাসক্ত। নেশার টাকা জোগাড় করতে শেষমেশ খুন করেন মাকেই।

- Advertisement -google news follower

মর্মান্তিক এ ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রাম নগরের পাহাড়তলী থানা এলাকায়। এ থানার ভেলুয়ার দিঘির উত্তরপাড়ে একটি ভাড়া ঘরে থাকেন রিনা আক্তাররা। তার স্বামী মো. আকতার হোসেন (৫২) পেশায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালক। আরেকজনের মালিকানাধীন অটোরিকশা ভাড়ায় চালিয়ে কোনোমতে জীবিকা নির্বাহ করছিলেন আকতার হোসেন।

ঘটনাটি ঘটে রোববার (২ জুন) দিবাগত রাত ১০টার দিকে। প্রতিদিনের মতো এদিন সকালেও দেরিতে ঘুম থেকে ওঠেন ওমর। মা-বাবা দুজনই তাকে ডেকে বোঝান এভাবে জীবন চলে না। তাকে মাদক ছাড়তে অনুরোধ করেন তারা। কিন্তু কে শুনে কার কথা। উল্টো রেগে ঘর থেকে বের হয়ে যান ওমর। জীবিকার সন্ধানে আকতার হোসেনও বেরিয়ে পড়েন সিএনজি নিয়ে।

- Advertisement -islamibank

এরপর রাত সাড়ে ১০টার দিকে অটোরিকশা নিয়ে আকতার হোসেন দাঁড়িয়ে ছিলেন নগরীর খুলশী থানার পাঞ্জাবি লেন পুলিশ বিট মোড়ে। তখন তিনি দেখেন, বটি হাতে এক তরুণ দৌড়াচ্ছে। পেছন থেকে তাকে ধাওয়া করছেন স্থানীয়রা। আকতার খেয়াল করে দেখেন যাকে ধাওয়া করা দেওয়া হচ্ছে সে তারই সন্তান। পরে দৌড়ে গিয়ে জানতে পারেন তার স্ত্রীকে বটি দিয়ে কুপিয়ে পালাচ্ছিলেন ওমর। স্থানীয়রা হাতেনাতে ধরে ফেলেন ওমরকে। ততক্ষণে ঘরে পড়ে থাকে রিনা আক্তারের ক্ষতবিক্ষত দেহ নিথর হয়ে যায়। পরে পুলিশ এসে ওমরকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। একইসঙ্গে পুলিশ রিনা আক্তারের মরদেহ উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে পাঠায়।

মাকে ক্ষতবিক্ষত করেও অনুশোচনা নেই ওমরের!

সোমবার দুপুরে চমেক হাসপাতালের মর্গে ময়নাতদন্তের জন্য রিনা আক্তারের মরদেহ কাটছিলেন ডোম। ওই সময় পাহাড়তলী থানা পুলিশ হেফাজতে ছিলেন ওমর। নিয়ম অনুযায়ী তাকে দুপুরের খাবার দেওয়া হয়। পাহাড়তলী জোনের সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) মো. মঈনুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, পুলিশ হেফাজতে ওমর দুপুরের খাবার খেয়েছেন। তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই কয়েক ঘণ্টা আগে তিনি গর্ভধারিণী মাকে উপর্যুপরি কোপে খুন করেছেন। একেবারেই ফুরফুরে মেজাজে ছিলেন।

করোনাকালের আগে পাহাড়তলী থানার রেলওয়ে স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন ওমর। টেনেটুনে পাস করলেও একমাত্র সন্তানকে শিক্ষিত করার চেষ্টায় ছিলেন মা-বাবা দুজনেই। ভর্তি করিয়েছিলেন ভাটিয়ারীর একটি কলেজে। এরপর নিয়মিত কলেজে যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হতেন ওমর। কিন্তু কলেজে আর যেতেন না। দিতেন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা। একপর্যায়ে শুরু করেন মাদক সেবন। এরপর আর ছাড়তে পারেননি।

ওমরের বাবা আকতার হোসেন বলেন, ছেলে মাদকে জড়িয়ে পড়ে ২০২১ সালের দিকে। আমরা কিছুদিন পরে টের পাই। তার মা-সহ অনেক বুঝিয়েছি। কিন্তু মাদক ছাড়াতে পারিনি। আমার অনুপস্থিতিতে মায়ের কাছ থেকে নানা কথা বলে মাদকের জন্য টাকা নিত। কোনো কোনো সময় টাকা না পেলে খারাপ আচরণ করত। তারপরও একমাত্র সন্তান হওয়ায় তাকে সুপথে আনার চেষ্টায় ছিলাম আমরা।

সব হারিয়ে নিঃস্ব হলেন আকতার হোসেন

আকতার হোসেনের বাড়ি কুমিল্লা বুড়িচং থানার কাবিলা মনিপুর তাতবাড়ী এলাকায়। তবে দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রামে থাকেন তিনি। এখানে পাহাড়তলী থানার ভেলুয়ার দিঘির উত্তরপাড়ে একটি ভাড়া ঘরে থাকেন। রিনা আক্তার তার দ্বিতীয় স্ত্রী। তার প্রথম স্ত্রী ব্লাড ক্যান্সারে মারা যান। মারা যাওয়ার সময় ওই সংসারে দেড় বছর বয়সী একটি কন্যাসন্তান ছিল তার। সেই সন্তানের দিকে তাকিয়ে বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি।

আকতার হোসেন বলেন, প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর থেকে আত্মীয়স্বজনরা আরেকটি বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। কিন্তু মেয়ের দিকে তাকিয়ে আমি বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিই। তবে আত্মীয়রা বেশি চাপ দেওয়ায় সিদ্ধান্ত নিই মেয়ে একটু বড় হলেই বিয়ে করব। আনুমানিক ২৫ বছর আগে রিনা আক্তারকে আমি বিয়ে করি। দ্বিতীয় বিয়ের বছরখানেক পর আগের সংসারের মেয়ে কুকুরের কামড়ে মারা যায়। কুকুরের কামড়ের পর না বুঝে আমরা বৈদ্যের শরণাপন্ন হয়ে টিকা দিইনি। আড়াই মাস পর জলাতঙ্ক রোগ হয়ে মেয়ে মারা যায়।

দ্বিতীয় সংসারে আমার ছেলে ওমরের জন্ম, যোগ করেন আকতার হোসেন। ততক্ষণে তার চোখ ছলছল করছিল। স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন আকতার।

তিনি জানান, আনুমানিক ২৩ বছর আগে ওমর তখন জন্মগ্রহণ করবে। প্রসববেদনা শুরু হলে তার মাকে নেওয়া হয় চমেক হাসপাতালে। সেখানে সিজারে ওমরের জন্ম হয়। ওইসময় সিজারের সেলাইয়ে রিনা আক্তারের ইনফেকশন হয়। দেড় মাস হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। নানা ওষুধ সেবনের কারণে সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম হয়ে যান রিনা আক্তার।

এ কারণে এক ছেলেকে নিয়েই জীবন পার করতে চেয়েছিলেন আকতার-রিনা দম্পতি। কিন্তু এই ছেলের হাতেই শেষমেশ তার মা খুন হলেন। এখন সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন আকতার। মাকে হত্যার মামলায় ওমর কারাগারে যাওয়ায় এ পরিবারে এখন আর তার কেউ রইল না।

যে মায়ের কোলে-পিঠে বড় হয়েছেন তার শরীরে ছেলের ৪৬ কোপ!

হত্যাকাণ্ডের পর যেকোনো মরদেহ উদ্ধার হলে প্রথমে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন পুলিশ কর্মকর্তারা। রিনা আক্তারের মরদেহ উদ্ধারের পর এ দায়িত্ব বর্তায় উপ-পরিদর্শক (এসআই) ইমাম হোসেনের ওপর। তিনি গুনে দেখেন এই মায়ের দেহে রয়েছে ৪৬টি কোপের চিহ্ন। এ ঘটনা তদন্তে গিয়ে মর্মাহত হয়েছেন তিনি। তদন্তের সঙ্গে জড়িত অন্য পুলিশ কর্মকর্তারাও হয়ে পড়েছেন কাতর।

এসআই ইমাম হোসেন বলেন, খুবই অমানবিক ঘটনা। সৎ মা নয়, নিজের গর্ভধারিণী মা। এভাবে খুন হওয়া দুঃখজনক। নিজের মা নয়, কোনো শত্রুকেও তো মানুষ এভাবে কোপ দেয় না।

চমেক হাসপাতালের মর্গে রিনা আক্তারে মরদেহ কাটার দায়িত্বে ছিলেন ডোম কদম আলী। তিনি বলেন, ওই নারীর দেহ একেবারেই ক্ষতবিক্ষত ছিল। সবচেয়ে বেশি কোপ মাথায় দিয়েছে। তার শরীরের দিকে তাকানোই যাচ্ছিল না।

বাবার মামলায় কারাগারে ছেলে, শাস্তি চান ফাঁসি, খুশি হতেন ক্রসফায়ার দিলে

স্ত্রীকে হত্যার ঘটনায় পাহাড়তলী থানায় নিজের ছেলের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন আকতার হোসেন। সোমবার মামলাটি থানায় রেকর্ড হয়। মামলাটিতে গ্রেপ্তার দেখিয়ে এ দিনই ওমরকে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। দু’একদিনের মধ্যে তার বিরুদ্ধে রিমান্ড আবেদন করা হবে বলে জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। তারপর থানায় এনে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে পাহাড়তলী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ইমাম হোসেনকে। তিনি বলেন, রোববার আসামিকে আদালতে পাঠানো করা হয়েছে। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রুমানা আক্তারের আদালত তাকে কারাগারে পাঠানো আদেশ দিয়েছেন। এরপর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। আগামী দু’একদিনের মধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পরামর্শে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে রিমান্ড আবেদন করা হবে।

ছেলের শাস্তি চান কি না– এমন প্রশ্নের জবাবে মামলার বাদী আকতার হোসেন বলেন, ছেলেটি আমার সব শেষ করেছে। আমার স্ত্রী রিনা আক্তারের মতো এমন ভালো মেয়ে আর হয় না। এরকম মাকে খুন করে সে আমার সব শেষ করে দিয়েছে। বিচারিক প্রক্রিয়ায় আমি চাই তার ফাঁসি হোক। আরও খুশি হতাম যদি তাকে পুলিশ ক্রসফায়ার দিতে পারত। যাতে দেশের জন্য এ ঘটনা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে এবং কোনো পরিবারে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়।

ওমর ফারুকের সহযোগীদেরও লাগাম টানতে বললেন বিশেষজ্ঞরা

ঘটনার বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মৌমিতা পাল বলেন, ওমর ফারুকরা একা নয়। তিনি নিশ্চয়ই তার বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছেন। তার সহযোগীরাও একই ঘটনা ঘটাতে পারেন। এজন্য তাদেরও চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে।

মৌমিতা পাল বলেন, একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে চট্টগ্রামে খুব অল্প বয়সীরা মাদকে জড়িয়ে পড়ছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে স্কুল ব্যাগে মাদক নিয়ে ঘুরে ছাত্ররা। তাদের ব্যাগ থেকে মাদক উদ্ধার হওয়ার ঘটনাও পাওয়া যাচ্ছে। সুতরাং মাদকের এই ভয়াল ছোবল থেকে দেশকে রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও তৎপর হতে হবে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট এস এম দিদার উদ্দিন বলেন, চট্টগ্রামের পাহাড়তলী থানার ঘটনাটি বেদনাদায়ক। এমন ঘটনা মানা যায় না। মাদকের ভয়াল ছোবলে চোখের সামনে একটি পরিবার ধ্বংস হয়ে গেল। মাদকের বিষয়ে পুলিশের তৎপরতা আরও বাড়াতে হবে। নজরদারি বাড়ানোর মাধ্যমে যেকোনো উপায়ে এটি বন্ধ করতে হবে। না হয় সামনে আরও ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে।

জেএন/এমআর

KSRM
পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জয়নিউজবিডি.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন news@joynewsbd.com ঠিকানায়।

এই বিভাগের আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ

×KSRM