২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে বৃহস্পতিবার (৬ জুন)। জাতীয় সংসদে বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসময় সংসদে উপস্থিত ছিলেন। এবারের বাজেটের স্লোগান- ‘সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকার’।
বাজেটের আকার : আয়-ব্যয় ও ঘাটতি
আজ পেশ করা দেশের ইতিহাসের ৫৪তম বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। আর ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা।
ঘাটতি মেটাতে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
এর মধ্যে বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ ধরা হয়েছে ১ লাখ ২৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ নেওয়া হবে ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নেওয়া হবে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা; যার ৭২ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা দীর্ঘমেয়াদি ঋণ এবং ৬৪ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা স্বল্পমেয়াদি ঋণ হবে। ব্যাংকবহির্ভূত ঋণ নেওয়া হবে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।
রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) লক্ষ্যমাত্রা চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। এনবিআর বহির্ভূত কর ধরা হয়েছে ১৫ হাজার কোটি টাকা। করব্যতীত প্রাপ্তির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৬ হাজার কোটি টাকা।
বাজেটে ঋণের সুদ পরিশোধের ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ৯৩ হাজার কোটি টাকা। আর বৈদেশিক ঋণের সুদ ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
এছাড়া ভর্তুকি ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা এবং সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন ও পেনশনে ব্যয় হবে ১ লাখ কোটি টাকা।
বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। যা চলতি অর্থবছরে ছিল ৭ দশমিক ৫ শতাংশ।
বাজেট ২০২৪-২৫ এর নানা দিক
>> মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে আনার লক্ষ্য
দীর্ঘদিন ধরে নিত্যপণ্যের বাজার চড়া। মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্ব গতিতে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকার। এজন্য বিশেষ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।
>> এমপিদের শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির সুবিধা বাতিল
সাধারণত, গাড়ি আমদানিতে কোনো শুল্ককর দিতে হয় না সংসদ সদস্যদের। পাঁচ বছরের জন্য একটি গাড়ি আমদানিতে এ সুবিধা পান এমপিরা। এবার এ সুবিধা আর থাকছে না। এমপিদের গাড়ি আমদানিতে ২৫ শতাংশ শুল্ক ও ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। এতে এমপিদের গাড়ি আমদানিতে মোট করভার হবে ৪৩ শতাংশ।
>> কালো টাকা সাদা করার সুযোগ
২০২০-২১ অর্থবছরে ১০ শতাংশ কর পরিশোধ সাপেক্ষে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছিল সরকার। চার বছর পর এবার আবারও কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে বলা হয়েছে, দেশের প্রচলিত আইনে যাই থাক না কেন কোনো করদাতা স্থাবর সম্পত্তি যেমন- ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট ও ভূমির জন্য নির্দিষ্ট করহারে এবং নগদসহ অন্যান্য পরিসম্পদের ওপর ১৫ শতাংশ কর পরিশোধ করলে কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো প্রকার প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারবে না।
>> করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে তিন লাখ
সাধারণ মানুষের বিশেষ করে চাকরিজীবীদের অনেক প্রত্যাশা থাকলেও প্রস্তাবিত বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হয়নি। অর্থাৎ আগের অর্থবছরের মতো এবারও ব্যক্তি শ্রেণির করদাতার বার্ষিক আয়সীমা ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা রাখা হয়েছে। তবে রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে সর্বোচ্চ আয়ের কর সীমা ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে।
করমুক্ত আয়সীমার বিষয়ে বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, আমি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিদ্যমান স্বাভাবিক ব্যক্তি করদাতা, ফার্ম ও হিন্দু অবিভক্ত পরিবারের করমুক্ত আয়ের সীমা অপরিবর্তিত রাখার প্রস্তাব করছি। একই সঙ্গে বিদ্যমান সর্বোচ্চ করহার ২৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ৩০ শতাংশে নির্ধারণের প্রস্তাব করছি।
>> কমবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখা ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে অন্তত ২৭টি প্রয়োজনীয় পণ্য ও খাদ্যশস্য সরবরাহের ওপর উৎসে কর কমানো হচ্ছে। ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এসব পণ্যে উৎসে কর ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করা হচ্ছে। পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে- পেঁয়াজ, রসুন, মটর, ছোলা, চাল, গম, আলু, মসুর, ভোজ্যতেল, চিনি, আদা, হলুদ, শুকনা মরিচ, ডাল, ভুট্টা, ময়দা, আটা, লবণ, গোলমরিচ, এলাচ, দারচিনি, লবঙ্গ, খেজুর, তেজপাতা, পাট, তুলা, সুতা এবং সব ধরনের ফলসহ ২৭ পণ্য।
>> দাম কমবে দেশি মোটরসাইকেলের
প্রস্তাবিত বাজেট অনুযায়ী, ২৫০ সিসির কম মোটরসাইকেলের দাম কমছে। কেননা মোটরসাইকেলের আমদানি করা যন্ত্রাংশের ওপর অতিরিক্ত ৩ শতাংশ শুল্ক অব্যাহতি দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
>> খরচ কমবে কিডনি রোগীদের
দেশে আনুমানিক প্রায় ৩ কোটি ৮০ লাখ মানুষ কোনো না কোনোভাবে কিডনি রোগে ভুগছেন। যদিও তাদের মধ্যে সব রোগীর ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন হয় না, তবে যারা ডায়ালাইসিস নেন প্রস্তাবিত নতুন বাজেটে তাদের জন্য সুখবর দেওয়া হয়েছে। ডায়ালাইসিসে ব্যবহৃত দুটি অত্যাবশ্যকীয় উপকরণের আমদানি শুল্ক কমানোর ফলে কিডনি ডায়ালাইসিসের খরচ কমতে যাচ্ছে।
>> একের অধিক গাড়ি মানেই বাড়তি কর
কোনো ব্যক্তির নামে একাধিক গাড়ি বা মোটরগাড়ি থাকলে অতিরিক্ত সারচার্জ দিতে হবে। এটিকে বলা হচ্ছে পরিবেশ সারচার্জ। একের অধিক প্রতিটি গাড়ির জন্য নানা হারে পরিবেশ সারচার্জ দিতে হবে। গাড়ির নিবন্ধন বা ফিটনেস নবায়নকালে এই সারচার্জ নেওয়ার বিষয়টি প্রস্তাবিত বাজেটে উল্লেখ করেছেন অর্থমন্ত্রী।
>> বিদেশ থেকে মোবাইল আনলে কর
শুল্ককর পরিশোধ করে এতদিন বিদেশ থেকে কোনো যাত্রী দুটি মোবাইল আনতে পারতেন। তবে নতুন ব্যাগেজ রুল অনুযায়ী নতুন মোবাইল আনতে হলে শুল্ক-কর পরিশোধ করতে হবে। এক্ষেত্রে ৩০ হাজার টাকা দামের মোবাইলের জন্য ৫ হাজার টাকা, ৩০-৬০ হাজার টাকা দামের মোবাইলের জন্য ১০ হাজার টাকা এবং ৬০ হাজার টাকার বেশি দামের মোবাইলের জন্য ২৫ হাজার টাকা শুল্ক দিতে হবে।
>> স্বর্ণ আনাসহ ব্যাগেজ রুলে পরিবর্তন
প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাগেজ রুলে বড় পরিবর্তন আনা হচ্ছে। যেখানে ২৪ ক্যারেট স্বর্ণালঙ্কার আনার সুযোগ বন্ধ হতে পারে। ২২ ক্যারেট বা তার নিচের ক্যারেটের স্বর্ণালঙ্কার ১০০ গ্রাম আনা যাবে।
প্রস্তাবিত বাজেট অনুযায়ী, আসন্ন বাজেটে ব্যাগেজ রুলে বড় পরিবর্তন আনা হচ্ছে। যেমন ২৪ ক্যারেট স্বর্ণালঙ্কার আনা যাবে না। ২২ ক্যারেট বা তার নিচের ক্যারেটের স্বর্ণালঙ্কার ১০০ গ্রাম আনা যাবে। ১২ বছরের কম বয়সীরা ব্যাগেজ সুবিধায় স্বর্ণালঙ্কার, স্বর্ণবার, মদ-সিগারেট আনতে পারবে না। অন্যদিকে যাত্রীর সঙ্গে আনা হয়নি এমন ব্যাগেজ (ইউ-ব্যাগেজ) শুল্কছাড় সুবিধা পাবে না। এ ধরনের ব্যাগেজে আনা পণ্যভেদে শুল্ককর পরিশোধ করতে হবে।
>> মোবাইল আলাপে বাড়তি খরচ
নতুন মোবাইল ফোনের সিম ব্যবহারে প্রদত্ত সেবার বিপরীতে সম্পূরক শুল্ক ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। ফলে নতুন অর্থবছরে মোবাইলের সিম ব্যবহারের জন্য গুনতে হবে বাড়তি টাকা।
>> কোমল পানিয়ের দাম বাড়বে
২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কার্বোনেটেড বেভারেজের ওপর কর আরোপ বৃদ্ধি করা হয়েছে। এতে করে কোক, স্প্রাইট ও পেপসিসহ কোমল পানীয়র দাম বাড়বে।
>> সিগারেটের সঙ্গে জর্দা ও গুলের দাম বাড়বে
প্রস্তাবিত বাজেটে সিগারেট, তামাক এবং তামাকজাত পণ্যের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। মূলত, তামাকজাত পণ্যের ব্যবহার কমানো এবং এই খাত থেকে রাজস্ব আয় বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর হচ্ছে।
>> ইন্টারনেটে বাড়তি খরচ
২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটে মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
এর আগে মোবাইল ইন্টারনেটের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট এবং ১৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক দিতে হতো গ্রাহকদের। এখন তা আরও ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এর সঙ্গে ভোক্তাদের ১ শতাংশ সারচার্জও দিতে হবে।
>> এসি ফ্রিজসহ ঘরের আসবাব কেনায় বাড়বে ব্যয়
প্রস্তাবিত বাজেটে বিভিন্ন ধরনের পণ্যে শুল্ক ও কর হ্রাস-বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। যেসব পণ্যের শুল্ক ও কর বাড়বে সেগুলোর বাজারমূল্যও বেড়ে যাবে।
>> শিক্ষায় বরাদ্দ ৯৫ হাজার কোটি
২০২৪-২৫ অর্থবছরে শিক্ষা এবং প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৯৪ হাজার ৮০৯ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৫৫ হাজার ৮৯১ কোটি টাকা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৮ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
>> স্বাস্থ্যখাত পেল ৪১ হাজার কোটি
২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য সেবা এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণের জন্য ৪১ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ছিল ৩৮ হাজার ৫১ কোটি টাকা।
>> আইসিটি খাতে বিশেষ সুবিধা
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) খাতে কর অব্যাহতির মেয়াদ ৩ বছর বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তবে বর্তমানে এই খাতের ২৭টি উপখাতে কর অব্যাহতির সুবিধা থাকলেও সেই সুবিধা কিছুটা কমে ২০টি খাতে নেমে আসতে পারে।
জেএন/এমআর