র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সাঁজোয়া যান কেনায় ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ২০১৮ সালে নেওয়া ওই প্রকল্পে দরপত্রের নিয়ম ভঙ্গের পাশাপাশি নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে যান কেনার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দামে নিয়ে আসা হয়েছে এসব নিরাপত্তা যান। যেখানে দেখা যাচ্ছে, বাজারদরের চেয়ে অন্তত ৩০০ শতাংশ বেশি অর্থ খরচ হয়েছে। বিশেষ নিরাপত্তা অস্ত্র সংযুক্ত ২ কোটি টাকা মূল্যের একটি গাড়ি কেনা হয়েছে ৬ কোটি টাকায়। এভাবে চারটি গাড়ি কিনতে খরচ হয়েছে ২৪ কোটি টাকা।
র্যাবের সক্ষমতা বাড়াতে ১ হাজার ৩৩ কোটি ৯৮ লাখ ৪০ হাজার টাকার প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল। ২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (একনেক) বৈঠকে প্রকল্পটির অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রকল্পের অধীনে ১ হাজার ৩৭৫টি বিভিন্ন ধরনের যানবাহন কেনার সিদ্ধান্ত হয়। ২৬টি আরমার্ড পারসোনেল ক্যারিয়ার (এপিসি) বা সাঁজোয় যান কেনার সিদ্ধান্ত ছিল সেই প্রকল্পেরই অংশ। যার মধ্যে চারটি এপিসি দেশে পৌঁছে গেছে। আরও ৫০ লাখ টাকা বাড়িয়ে ফের ১০টি এপিসি কেনার আবেদন করা হয়েছে। হিসাব বলছে, এরই মধ্যে কেনা চারটি গাড়িতে রাষ্ট্রের ক্ষতি হয়েছে ১৬ কোটি টাকা। বাকি ২২টি সাড়ে ৬ কোটি টাকা করে কিনলে ক্ষতি হবে ৯৯ কোটি টাকা।
‘র্যাব ফোর্সেসের আভিযানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি’ শীর্ষক প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদনের পর যানবাহন কিনতে মূল্য নির্ধারণী কমিটি গঠন করা হয়। গত বছরের ৩০ নভেম্বর র্যাব সদর দপ্তরের সম্মেলন কক্ষে সভা করে কমিটি। ওই সভার কার্যবিবরণী থেকে জানা গেছে, প্রকল্পে ছয়টি জলযানসহ ১ হাজার ৩৭৫টি বিভিন্ন ধরনের যানবাহন অন্তর্ভুক্ত। এসব যানবাহনের মধ্যে ৭৩৫টির ক্রয়মূল্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত দর অনুযায়ী প্রস্তাবিত। বাকি ৬২৪টির বাজারদর বিবেচনায় ডিপিপির মূল্য বহাল রাখা হয়। যেখানে প্রস্তাবিত প্রতিটি এপিসির মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৬ কোটি টাকা করে।
র্যাব সদরদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২৬টি এপিসি প্রস্তাব করা হলেও প্রাথমিকভাবে চারটি কেনার সিদ্ধান্ত হয়। এপিসিগুলো কিনতে গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর অর্থ ছাড়ের বিষয়টি গণমাধ্যমকর্মীদের নিশ্চিত করেছিলেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব সাঈদ মাহবুব খান। তিনি সেদিন ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, চারটি এপিসি কিনতে খরচ হবে প্রায় ২৪ কোটি টাকা। ইন্টেল এইজ অ্যান্ড করপোরেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান এগুলো সরবরাহ করবে বলেও জানিয়েছিলেন তিনি। র্যাব সূত্রে জানা গেছে, গত ১৭ মে চারটি এপিসি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাস করে র্যাব সদরদপ্তরে আনা হয়। এসব এপিসি উদ্বোধন করা হয় পরদিন ১৮ মে। সূত্র বলছে, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের (আইসিটি) মাধ্যমে না কিনে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে এপিসিগুলো কেনা হয়। সরাসরি ক্রয়ে অভিজ্ঞ বা সরকারি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়ার বিধানও মানা হয়নি।
র্যাব সূত্রে আরও জানা গেছে, চলতি বছরের ১১ মার্চ র্যাব সদরদপ্তরে যানবাহনের মূল্য নির্ধারণী কমিটির আরেকটি সভা হয়। সেই সভার কার্যবিবরণী কালবেলার হাতে এসেছে। সেখানে লেখা রয়েছে, ৭৩৫টি যানবাহনের ক্রয়মূল্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত দর অনুযায়ী প্রস্তাবিত। মূল্য নির্ধারণী কমিটির মাধ্যমে শুধু ২৬টি এপিসির বর্তমান বাজারমূল্য নির্ধারণ করা হলো। অবশিষ্ট ৫৯৮টি যানবাহনের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাজারদর বিবেচনা করে অনুমোদিত ডিপিপির মূল্য বহাল রাখা হয়েছে। কার্যবিবরণীর নিচের দিকে একটি অংশে বিভিন্ন যানবাহনের মূল্যতালিকা দেওয়া হয়। ওই তালিকার ১২ নম্বরে থাকা এপিসির মূল্য আরও ৫০ লাখ টাকা বাড়িয়ে ধরা হয়েছে ৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা। জানা গেছে, এই দামে আরও ১০টি এপিসি কিনতে অর্থ ছাড়ের আবেদন করা হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এই প্রকল্পের ডিপিপিতে আইসিটির মাধ্যমে এপিসি কেনার নির্দেশনা থাকায় ডিপিএম পদ্ধতিতে কেনা অসম্ভব হয়ে পড়ে। আইসিটিকে ডিপিএমে রূপান্তর করতে হলে আলাদাভাবে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। সাধারণত চারটি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেতে পাঁচ থেকে ছয় মাস সময় লাগে। কিন্তু সাঁজোয়া যানগুলো কেনার ক্ষেত্রে মাত্র এক মাসের মধ্যে সব প্রক্রিয়া শেষ হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর ভাগ্নি জামাই পরিচয় দেওয়া ব্যবসায়ী খালেদুর রহমান শাকিলের নাম আলোচনায় আসে। এপিসির উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ছিলেন এই শাকিল। জানা গেছে, মন্ত্রীর আত্মীয় হওয়ার সুবাদে শাকিলের সঙ্গে র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বেশ সখ্য রয়েছে। ওই দুই কর্মকর্তার বিসিএস ব্যাচমেট রয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। তাদের মাধ্যমেই শাকিল দ্রুত ডিপিপি প্রস্তাব আইসিটি থেকে ডিপিএমে রূপান্তর করান। পরে বাংলাদেশি বেসরকারি ইন্টেল এইজ অ্যান্ড করপোরেশন নামের
একটি কোম্পানিকে কার্যাদেশ দিয়ে ২৪ কোটি টাকায় চারটি এপিসি কেনে র্যাব। এই ইন্টেল এইজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হলেন এই ব্যবসায়ী খালেদুর রহমান শাকিল।
সরাসরি অনুসন্ধান এবং অনলাইন সার্চ করে ‘ইনটেল এইজ অ্যান্ড করপোরেশন’ নামের কোনো কোম্পানির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ইন্টেল এইজের একটি পেইজ খুঁজে পাওয়া যায়। যেটি তৈরি করা হয়েছে ২০২২ সালের ৮ মার্চ। কোম্পানিটির পেইজে লাইক রয়েছে মাত্র ৪৮টি। পেইজে লেখা রয়েছে, ‘ইন্টেল এইজ ২০২২ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি কোম্পানি। কোম্পানিটি কমিশনিং এজেন্ট হিসেবে নিবন্ধিত এবং বাংলাদেশ সরকারের সব ধরনের প্রতিরক্ষা-সংক্রান্ত পণ্যের চাহিদা বা পরিষেবা সরবরাহকারী হিসেবে নিবন্ধিত। এ ছাড়া পেইজে একটি ওয়েবসাইটের (www.inteledgeltd.com) ঠিকানা দেওয়া থাকলেও সেটি সচল নয়।
ডিপিএমের শর্ত অনুযায়ী, সরকারি কিংবা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কোম্পানিকে কার্যাদেশ দেওয়ার শর্ত থাকলেও দেওয়া হয়েছে সদ্য ভূমিষ্ঠ একটি কোম্পানিকে। ইন্টেল এইজ দুবাইয়ের একটি কোম্পানির থেকে এসব এপিসি কিনে র্যাবকে সরবরাহ করেছে বলে জানা গেছে। দুবাইয়ের ওই কোম্পানির নাম স্ট্রেইট গ্রুপ (streit group)। দুবাইয়ের এ কোম্পানিটি বিশ্বব্যাপী সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন সরঞ্জাম সরবরাহ করে থাকে। র্যাব সদর দপ্তরে জমা দেওয়া ‘streit group’-এর দরপত্রের একটি কপি এসেছে কালবেলার হাতে। সেখানে স্পেসিফিকেশন ভেদে এপিসির দাম ১ লাখ ২০ হাজার ডলার থেকে ২ লাখ ৫০ হাজার ডলার পর্যন্ত দেখানো হয়েছে। ৩০ নভেম্বর মূল্য নির্ধারণী তারিখে দেশে ডলারের মূল্য ছিল ১১০ টাকা। সে হিসাবে এসব এপিসির মূল্য দাঁড়ায় ১ কোটি ৩২ লাখ থেকে ২ কোটি ৭৫ টাকা। জানতে চাইলে খালেদুর রহমান শাকিল কালবেলাকে বলেন, ‘২৩ কোটি সামথিং মূল্যে র্যাবকে চারটি এপিসি সরবরাহ করেছি। প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দরপত্রের মাধ্যমে তাদের সরবরাহ করা হয়েছে।
ক্রয় কমিটির এক সদস্য নিশ্চিত করেছেন, র্যাবের কেনা এপিসিগুলোর দাম ১ লাখ ৭০ হাজার মার্কিন ডলার। ১১০ টাকা ডলার মূল্যের হারে এসব এপিসির মূল্য দাঁড়ায় ১ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। বিষয়টি নিশ্চিত করতে যোগাযোগ করা হয় স্ট্রেইট গ্রুপ নামের ওই কোম্পানির সঙ্গে। কোম্পানিকে এসব এপিসির স্পেসিফিকেশন চেয়ে মেইল করা হয়। তারা মেইলের উত্তর দেননি। এরপর কোম্পানির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার হোয়াটসঅ্যাপে দামের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। উত্তরে তিনি নির্দিষ্ট কোম্পানির ডিটেইলস তথ্য এবং সক্ষমতা বিষয়ে তথ্যসহ আবেদন করতে বলেন। পরবর্তী সময়ে গণমাধ্যমের হাতে থাকা কোটেশন পেপার ওই কোম্পানিকে পাঠিয়ে ওই কোটেশন পেপার তাদের কি না—জানতে চাইলে বিষয়টি কোম্পানির পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়। র্যাবকে সরবরাহ করা এপিসি এবং কোটেশন পেপারের দামের আকাশপাতাল ব্যবধান দেখা যায়। র্যাব এসব এপিসি কিনেছে প্রতিটি ৬ কোটি টাকা মূল্যে, যা বাজারদরের চেয়ে প্রায় ৩০০ শতাংশ বেশি।
মূল্য নির্ধারণ কমিটির এক সদস্য বলেন, ‘ইন্টেল এইজ অ্যান্ড করপোরেশন’ নামের যে প্রতিষ্ঠান থেকে এপিসি কেনা হয়েছে এই প্রতিষ্ঠানটি বাজারে এসেছে ২০২২ সালে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে কেনাকাটায় কোনো সীমাবদ্ধতা আছে কি না—জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ‘এ ধরনের কোনো বিধিনিষেধ নেই। একই ডিপিপিতে র্যাব আইসিটি টেন্ডারের মাধ্যমে র্যাবের গোয়েন্দা শাখার জন্য সরঞ্জাম কিনেছে।’
ট্রান্সফারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, র্যাব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। আমরা মনে করি, র্যাবের জন্য স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা বাধ্যতামূলক। তারা জনগণের টাকা খরচ করে তিন গুণ দামে জিনিসপত্র কিনলে তা বড় ধরনের অনিয়ম। রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়। এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত এবং যারা তাদের প্রশ্রয় দিয়েছে সবাইকে আইনের আওতায় আনতে হবে। নিশ্চয় এ কাজের সঙ্গে পুরো বাহিনী জড়িত নয়। যারা জড়িত তাদের আইনের আওতায় না আনা হলে র্যাবের প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে যাবে।
জানতে চাইলে র্যাবের সদ্য সাবেক ডিজি এম খুরশীদ হোসেন বলেন, ২০১৮ সালে এগুলোর মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ কোটি সামথিং বাংলা টাকায়। তখন ডলার ছিল ৮০ টাকা। কিন্তু বর্তমানে ডলার রেট ১১৫ টাকা আর এপিসি ক্রয় করা হয়েছে ৬ কোটির কমে। আগের দাম ধরলে মূল্য ৭ কোটি ছাড়াবে। তা ছাড়া এগুলো সাউথ আফ্রিকা থেকে অর্ডার দিয়ে বানানো, এগুলো রাইট হ্যান্ড। পৃথিবীর কোর এপিসির মধ্যে এসি নেই, এগুলোতে এসি আছে। ব্যবসায়ী খালেদুর রহমান শাকিলের মাধ্যমে ক্রয় করেছেন কি না—এমন প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে এম খুরশীদ হোসেন বলেন, শাকিল কোনো বিষয় নয়। তা ছাড়া এগুলো ডিজি একা কেনেননি। মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে কেনা হয়েছে।সূত্র: কালবেলা
জেএন/এমআর