দেশের ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে ব্ড় বাজার খাতুনগঞ্জ। শুধুমাত্র মৌখিক বিশ্বাস আর সাংকেতিক ভাষায় এই খাতুনগঞ্জে প্রতিদিন হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়, লেনদেন হয়।
দেশখ্যাত এই খাতুনগঞ্জ এখন ক্রমশ তার জৌলুস হারাতে বসেছে প্রতারণা আর বিশ্বাসভঙ্গের কারণে। বিশ্বাসভঙ্গের জন্য শত শত কোটি টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অসংখ্য ব্যবসায়ী।
সর্বশেষ খাতুনগঞ্জের সোনা মিয়ার মার্কেটের নুর ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী নাজিম উদ্দিন নামের এক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে বড় ধরনের প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে।
জানা গেছে, ডিও ট্রেডিং সিস্টেমের অপব্যবহার করে দীর্ঘদিন ধরেই খাতুনগঞ্জ বাজারে এলাচের ব্যবসা চালিয়ে আসছিলো। সে প্রথমে ব্যবসায়ীদের আস্তা অর্জন করেছিলো।
পরে সে বিশ্বস্ততাকে পুঁজি করে মশলাজাতীয় পণ্য এলাচের ডিও (সরবরাহ আদেশ) স্লিপ বিক্রির মাধ্যমে পণ্য সরবরাহ কিংবা অর্থ ফেরত না দিয়ে প্রায় শতাধিক ব্যবসায়ীর কোটি কোটি টাকা নিয়ে গা-ঢাকা দিয়েছেন নাজিম উদ্দিন।
এ নিয়ে বেশ কয়েকদিন ধরেই ব্যাপক গুঞ্জন চললেও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা কেউ মুখ খুলতে চাইছে না।
কয়েকজন ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, অবৈধ স্লিপ বা ডিও লেনদেনের জন্য এই খাতুনগঞ্জ বাজার দীর্ঘদিন ধরেই পরিচিত। আইনি দিক থেকে ডিও কেনাবেচার বিষয়টি ‘গ্রে জোন’ এ কাজ করলেও বিনাশ্রমে অধিক মুনাফা অর্জনের লালসায় অনেকেই জড়াচ্ছেন জুয়া খেলার মতো এই অবৈধ লেনদেনে। ডিও স্লিপের অপব্যবহারে প্রায়শই আকাশচুম্বী হতে দেখা যায় পণ্যের দাম।
খাতুনগঞ্জের একাধিক ব্যবসায়ী জানান, বাজারের সোনামিয়া মার্কেটে দীর্ঘদিন ধরে ভোজ্যতেল ও চিনিসহ বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের ব্যবসা করে আসছেন নূর ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী নাজিম উদ্দিন। যেই মার্কেটটি ভোগ্যপণ্যের অবৈধ ডিও বা স্লিপ বাণিজ্যের জন্য আলোচিত।
মার্কেটটিতে গত কয়েক মাস থেকে এলাচ নিয়ে ডিও বাণিজ্য শুরু হলে নাজিমও এই ব্যবসা শুরু করেন।
এরমধ্যে গত বুধবার (৫ জুন) অনেক ব্যবসায়ীর কাছে এলাচের ডিও বিক্রি করে টাকা নগদায়ন করে হঠাৎ মোবাইল বন্ধ করে দেন নাজিম।
ওইদিন কমপক্ষে ৫ কোটি টাকার এলাচের ডিও বিক্রি করলেও তার বিপরীতে ক্রেতাদের পণ্য কিংবা টাকা কোনোটাই দেননি এই ব্যবসায়ী।
এমনকি, ঘটনার তিন-চার দিন আগে থেকে যেসব ব্যবসায়ীর কাছ থেকে তিনি পণ্য কিংবা ডিও কিনেছেন, তাদের টাকাও পরিশোধ করেননি।
ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা জানান, বুধবার সন্ধ্যায় বিষয়টি আলোচনায় আসার পর পাওনাদার ব্যবসায়ীরা নাজিমকে খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের অফিসে নিয়ে যান।
ওই সময় কমপক্ষে ৪০-৫০ জন পাওনাদার তাদের পাওনার বিষয়ে অভিযোগ দেন অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের কাছে। ঘটনার সুরাহা না হওয়ায় ওই দিন রাতে তাকে সমিতির কার্যালয়ে আটকে রাখা হয়।
পরদিন তার ভগ্নিপতি এসে সমিতির নামে ১০ কোটি টাকার চেক দিয়ে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান।
ভুক্তভোগী তানিশা এন্টারপ্রাইজের আব্দুল মান্নান জানান, গত মঙ্গলবার নূর এন্টারপ্রাইজ থেকে তিনি ১১ টন এলাচের ডিও কিনেন। কিন্তু এর বিপরীতে এলাচ কিংবা চেক কোনোটাই দেননি নাজিম।
“আরও কয়েকজন ব্যবসায়ীর কাছে নাজিমের দেওয়া চেক পাস না হওয়ায় তার প্রতারণার বিষয়টি সামনে আসে। এরপর আমরা তাকে ব্যবসায়ী সমিতির অফিসে নিয়ে যাই। সমিতি থেকে পাওনা পরিশোধের সময় নিয়ে এখন তিনি বাজার থেকে উধাও হয়ে গেছেন,” বলেন আব্দুল মান্নান।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালক এবং খাতুনগঞ্জের আরএম এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আলমগীর পারভেজ বলেন, খাতুনগঞ্জের সোনা মিয়া মার্কেটের নুর ট্রেডিংয়ের মালিক নাজিম উদ্দিন এলাচের স্লিপ বিক্রি করে বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাত করেছেন, এমন অভিযোগ আমরা পেয়েছি।
পরে অভিযুক্ত ব্যবসায়ীকে নিয়ে প্রায় মার্কেটের অর্ধশত ব্যবসায়ী গত বুধবার রাতে সমিতির কার্যালয়ে আসে। তারা প্রায় অর্ধশত কোটি আটকে যাওয়ার বিষয়ে অভিযোগ করেন। আমরা অভিযুক্ত নাজিমের সাথে কথা বলেছি। সে পাওনা টাকা পরিশোধ করার আশ্বাস দিলে আমরা তাকে তার ভগ্নিপতির জিম্মায় ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু ছাড়া পাওয়ার পর সে আত্মগোপনে চলে যায়।
এ ঘটনায় পাওনাদাররা কে কত টাকা পাবেন, এটি বের করার জন্য ১১ সদস্যের একটি কমিটি করে দেয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এসএম ওবায়েদুল হক বলেন, দুইজন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ঘটনাটির বিষয়ে জেনেছি। তারা মৌখিকভাবে বিষয়টি অবগত করেছেন। লিখিত অভিযোগের পর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জেএন/পিআর