ঢাকার স্বামীবাগে কে এস দাস লেনের রোজ গার্ডেনে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা হয়। তবে দলটির জন্মসূত্রের সঙ্গে পুরনো ঢাকার ১৫০ নম্বর মোগলটুলিতে শওকত আলীর বাসভবনের সম্পর্ক ছিল অবিচ্ছেদ্য। উপমহাদেশ বিভক্তির আগে ঢাকার ১৫০ মোগলটুলিতে স্থাপিত হয়েছিল ‘ওয়ার্কার্স ক্যাম্প’ ও মুসলিম লীগ পার্টি হাউস। কলকাতা থেকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী একটি মামলা পরিচালনার জন্য ঢাকায় এলে তিনি শওকত আলীকে মুসলিম লীগ ছেড়ে ভিন্ন একটি রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার পরামর্শ দেন। তার পরামর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে পূর্ববঙ্গ কর্মীশিবিরের নেতাদের নিয়ে নতুন সংগঠন গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ হন তিনি। ১৫০ নম্বর মোগলটুলির শওকত আলীর বাসভবন ও কর্মীশিবির অফিসকে ঘিরে কয়েকমাসের প্রস্তুতিমূলক তৎপরতার পর রোজ গার্ডেনে আওয়ামী লীগের জন্ম হয়েছিল। ওই সময় দলের স্থায়ী কোনও কার্যালয় না থাকায় ১৫০ মোগলটুলিকেই অস্থায়ী কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ছাত্রলীগের গোড়াপত্তনও হয়েছে মোগলটুলির এই ঠিকানায়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু দেশ বিভাগের পর স্থায়ীভাবে কলকাতা ছেড়ে এই মোগলটুলিতে এসে ওঠেন।
১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠার ৬ বছরের মাথায় ১৯৫৫ সালের সম্মেলনে অসাম্প্রদায়িক রূপ দিতে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে দলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শামসুল হক ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে আওয়ামী লীগের জন্ম হয়।
বাঙালির স্বাধিকার আদায়ে গঠিত এ দলটি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমানে সফলতার উচ্চ শিখরে অবস্থান করছেন। দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকাকালে শেখ হাসিনা ১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগের সূর্বণজয়ন্তী পালন করেন। এবারও শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালে তার নেতৃত্বে দলটি পালন করছে প্লাটিনাম জুবিলি। প্রতিষ্ঠার ৭৫তম বার্ষিকী পালন করতে যাওয়া আওয়ামী লীগকে চলার পথে নানা বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে এগোতে হয়েছে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বধানদারী এ দলটিকে। দলটি গঠনের পেছনেও রয়েছে অনেক গল্প।
‘আওয়ামী লীগ: উত্থান পর্ব ১৯৪৮-১৯৭০’ বইয়ে লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন দলটি গঠনের পেছনের কথা। তিনি বলছেন, ‘১৯৪৮ সালে পাকিস্তান হওয়ার পরে ঢাকায় মুসলিম লীগের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন মাওলানা আকরাম খান এবং খাজা নাজিমুদ্দিন। সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশেম নেতৃত্বাধীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অনুসারী যে প্রোগ্রেসিভ [উদারপন্থী) নেতারা ছিলেন, তারা তখন সেখানে নিজেদের অবহেলিত মনে করছিলেন। তখন তারা মোগলটুলিতে ১৫০ নম্বর বাড়িতে একটি কর্মী শিবির স্থাপন করেছিলেন। সেখানে তারা একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করার কথা চিন্তা করছিলেন। কলকাতা থেকে এসে শেখ মুজিবুর রহমান তাদের সঙ্গে যুক্ত হন।
এখানে উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ গঠনের আগেই গঠিত হয় ছাত্রলীগ। বঙ্গবন্ধুই ছাত্রলীগ গঠন করেন এবং সেটারও কার্যালয় করা হয় ওই মোগলটুলিতেই।’
‘টাঙ্গাইলে প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ’র পদত্যাগে শূন্য হওয়া মুসলিম লীগ বিরোধী প্রার্থী হিসেবে শামসুল হক জয়ী হন। তবে ওই নির্বাচনি ফলাফল নির্বাচন কমিশন অবৈধ ঘোষণা করে’, বলে লেখক মহিউদ্দিন তার বইয়ে উল্লেখ করেন। তিনি আরও লিখেছেন, ‘বিভিন্নভাবে বঞ্চিত পুরনো মুসলিম লীগ কর্মীরা এ সময় মিলে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করার কথা ভাবতে শুরু করেন। তারা একটি সভা ডাকেন। সেই সভা ডাকার প্রস্তুতি কমিটির সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী, আর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ইয়ার মোহাম্মদ খান। কিন্তু সেই সভা করার জন্য কোনও অডিটোরিয়াম পাওয়া যাচ্ছিলো না। তখন কে এম দাস লেনের কাজী হুমায়ুন রশীদ তার মালিকানাধীন রোজ গার্ডেনে সভা করার আহ্বান জানান।’
‘সেখানেই ২৩ শে জুন বিকালে আড়াইশো-তিনশো লোকের উপস্থিতিতে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর প্রস্তাব অনুযায়ী, সেই দলের নামকরণ করা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। সেই সঙ্গে পুরো পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংগঠনের নাম রাখা হয় ‘নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’, যার সভাপতি হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।’
অধ্যাপক হারুন অর রশিদ তার ‘মূলধারার রাজনীতি: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কাউন্সিল ১৯৪৯-২০১৬’ বইয়ে আওয়ামী লীগের প্রথম কমিটির কথা তুলে ধরেছেন। তার বইয়ের তথ্যমতে, নতুন দল গঠনের পর মওলানা ভাসানীকে দায়িত্ব দেওয়া হয় একটি নতুন কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করার জন্য। তিনি অন্যদের সঙ্গে পরামর্শ করে একটি কমিটি ঘোষণা করেন।
সেই নতুন কমিটির সভাপতি হন মওলানা ভাসানী। সহ-সভাপতি হলেন আতাউর রহমান খান, আবদুস সালাম খান, আলী আমজাদ খান, আলী আহম্মদ খান ও শাখাওয়াত হোসেন। সাধারণ সম্পাদক হলেন শামসুল হক। শেখ মুজিবুর রহমান তখন কারাগারে আটক থাকলেও তাকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করা হয়। সহসম্পাদক করা হয় খন্দকার মোশতাক আহমদ এবং এ কে এম রফিকুল ইসলামকে। ট্রেজারার হন ইয়ার মোহাম্মদ খান।
নতুন দলের জন্য ৪০ সদস্য বিশিষ্ট একটি ওয়ার্কিং কমিটি করা হয়। এই কমিটিতে ছিলেন— বেগম আনোয়ারা খাতুন এমএলএ, খয়রাত হোসেন এমএলএ, আবদুল হামিদ চৌধুরী, মোল্লা জালাল উদ্দিন আহমদ, আবদুল আউয়াল, আলমাস আলী, শামসুজ্জোহা প্রমুখ।
শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য ছিলেন। তবে সরকারি চাকরির (অ্যাডভোকেট জেনারেল, যা বর্তমানে অ্যাটর্নি জেনারেল পদ) কথা বলে তিনি পদত্যাগ করেন। অল্প কয়েকদিনের মাথায় সহসভাপতি শাখাওয়াত হোসেন ও সহ সম্পাদক এ কে এম রফিকুল ইসলামসহ কয়েকজন বিবৃতি দিয়ে পদত্যাগ করেন।
আওয়ামী লীগ গঠনের পর সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া ও দলের সভাপতি ভাসানীর সঙ্গে তার মতপার্থক্যের কারণে ক্রমান্নয়ে দলে নিষ্ক্রীয় হয়ে যান। সর্বোপরি তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ায় ১৯৫২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান বলে মহিউদ্দিন আহমদ তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন। পরের বছর ১৯৫৩ সালে ঢাকার মুকুল সিনেমা হলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্মেলনে তাকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ওই সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সাংগঠনিক রিপোর্ট পেশ করেন।
জেএন/এমআর