২০০৮ সালের ২৪ ডিসেম্বর একটি জাতীয় ইংরেজি দৈনিকে আমি একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম যার শিরোনাম ছিল: পরিবর্তনের পক্ষে রায় দিন (ভোট ফর এ চেঞ্জ)। ঠিক দশ বছর পর আবারও লেখার সৌভাগ্য হচ্ছে আগামী ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিতব্য একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে। তবে, এবার লিখতে চাই উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার পক্ষে এবং তা সংগত ও যৌক্তিক কারণেই। কেননা আগামীর বাংলাদেশ কেমন হবে এবং কীভাবে এগিয়ে যাবে তা আসন্ন নির্বাচনের ফলাফলের মাধ্যমে প্রতিভাত হবে। অর্থাৎ এ নির্বাচনের সাথে বাংলাদেশের এগিয়ে চলা অনেকাংশেই নির্ভর করছে।
বাংলাদেশের কোন সচেতন ও দায়িত্ববান নাগরিক কী অস্বীকার করতে পারবেন যে, উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার মানদণ্ডে বিগত ১০ বছরের আওয়ামী লীগ শাসনামলে বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে এগিয়েছে? এটি কি শুধু আওয়ামী লীগ সমর্থকদের দাবি না বিশ্ববাসীর স্বীকৃতি যে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বিশ্বের বিস্ময় ও রোল মডেল হিসেবে আর্বিভূত হয়েছে? আর এটি কি শুধু ফাঁকা বুলির মাধ্যমে সাধিত হয়েছে? অবশ্যই নয়। দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য আওয়ামী লীগ সরকার বিগত ১০ বছর নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়েছে। সরকারের কিছু কর্মসূচি অধিকতর সফল হতে পারতো।
তবে এটি অস্বীকার করার কি কোন সুযোগ আছে যে, দলটি দেশকে এমন একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করেছে যা চলমান থাকলে দেশ উত্তরোত্তর অনেকদূর এগিয়ে যাবে? বিশ্বের তাবৎ বড় বড় অর্থনীতিবিদদের অভিভূত করে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অগ্রগতির সূচকে দ্রুত অগ্রসরমান প্রধান ৫টি দেশের মধ্যে পরিগণিত হচ্ছে এবং ইতোমধ্যে শতকরা৭.৮৬ ভাগ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে যা আগামী দু’ বছরে ভারতকেও ছাড়িয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে যাতে করে সকল স্তরের মানুষের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে।
মানুষের মাথা পিছু আয় বিগত ১০ বছরে তিনগুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ১৭৫১ মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। বেশিরভাগ সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকে বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের এবং প্রতিবেশী দেশগুলোকে অতিক্রম করে ফেলেছে। বাংলাদেশ যে কেবল বিশ্ব দরবারে তাঁর সরব উপস্থিতি জানান দিয়েছে তা কিন্তু নয়। বাংলাদেশের সফল রাষ্ট্রনায়কও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সক্ষমতা ও ক্যারিশমার স্বীকৃতিস্বরূপ দেশের জন্য বয়ে এনেছেন “প্ল্যানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন এওয়ার্ড” এবং “এজেন্ট ফর চেঞ্জ” এর মত আন্তর্জাতিক ও বিখ্যাত পুরস্কার। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের মত মেগা প্রজেক্ট এর কাজ অনেকাংশে সম্পন্ন করা বাংলাদেশ ও তাঁর নেতৃত্বের সক্ষমতার আরেক জাঞ্জল্যমান উদাহরণ।
বিগত ১০ বছরে দেশের অর্থনীতির ভিত্তিকে সুদৃঢ় ও শক্তিশালী করে বৈদেশিক রপ্তানি আয় তিনগুণের বেশি বেড়ে বর্তমানে ৪১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উপনীত হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অনেকগুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। দ্রুত শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক জোন সৃষ্টি করা হয়েছে। রেকর্ডসংখ্যক বই বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে যা শীঘ্রই ৪৫ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে। সরকারি বৃত্তি ও স্টাইপেন্ড এর আওতায় এসেছে প্রায় ২২ মিলিয়ন শিক্ষার্থী। প্রাথমিক শিক্ষার পর ঝড়ে পড়ার হার ব্যাপকভারে কমে এসেছে এবং স্বাক্ষরতার হার ৭৩ এর কাছাকাছি চলে এসেছে।
এখানে অবশ্যই উল্লেখের দাবি রাখে যে, একদা দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত এ দেশে এখন শতকরা ৯০ ভাগের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার উপরে বসবাস করছে এবং বেকারত্বের হার শতকরা ৪ ভাগের কাছাকাছি নেমে এসেছে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে যার মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ সুবিধাবঞ্চিত, অসহায় ও অক্ষম মানুষ সরাসরি সরকারি আর্থিক সহযোগিতার সুবিধাভোগী হয়েছে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভাতা প্রদান ও বৃদ্ধি এ সরকারের আরেক কৃতিত্ব যা কেবল আওয়ামী লীগ সরকার এর পক্ষেই সম্ভব। দেশের অভাবনীয় অবকাঠামোগত উন্নয়নের পরিসংখ্যান এর ভার পাঠকদের কাছেই ছেড়ে দিলাম। অন্য অবকাঠামো বাদ দিলেও বিশাল বিশাল উড়াল সড়কগুলো আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়নের প্রতিবিম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
বিগত ১০ বছরে বেশ কিছু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এবং অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। বিগত ১০ বছরে বিদ্যুত খাতে সরকারের সাফল্য ছিল ঈর্ষনীয়। ৪০০০ এর চেয়ে কম মেগাওয়াট থেকে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২১০০০ মেগাওয়াটে যার ফলে লোডশেডিং অনেকাংশে কমে এসেছে। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে সেবা জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এ সরকারের প্রচেষ্টা ও সক্ষমতা সর্বজনবিদিত এবং এর সুবিধাভোগী দেশের প্রায় প্রত্যেকটি মানুষই। এক্ষেত্রে চালিকাশক্তির ভূমিকা পালনকারী মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজিব ওয়াজেদ জয় পেয়েছেন “আইসিটি ফর ডেভেলপমেন্ট এওয়ার্ড – ২০১৬”।
জঙ্গিবাদ দমনে সরকার যে সাফল্য দেখিয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহসহ আরও অনেক দেশের জন্য তা অনুকরণীয় হচ্ছে। যে পাকিস্তানিরা একসময় বাঙালিদেরকে খাটো করে দেখতো তারা এখন তাদের সরকারকে বাংলাদেশ ও তাঁর নেতৃত্বকে অনুসরণ করার পরামর্শ দিচ্ছে যাতে করে পাকিস্তান হতাশা ও বিশৃঙ্খলার গোলকধাঁধা থেকে বের হয়ে এসে উন্নয়নের পথে অগ্রসর হতে পারে। আমাদের দেশের একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী যারা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোর বিরোধিতা করেছিল তাদের কেউ কেউ এখনওপাকিস্তানের প্রতি অনুরক্ত। বর্তমানে পাকিস্তানিদের উল্লিখিত চিন্তাধারার বহিঃপ্রকাশ অর্থাৎ বাংলাদেশকে অনুসরণ করার পরামর্শ তাদের মোহমুক্তি ঘটাতে যথেষ্ট নয় কী?
স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর মাধ্যমে শেখ হাসিনার দৃঢ় বিশ্বাস ও মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অঙ্গীকারের সুস্পষ্ট প্রতিফলন ঘটেছে। তবে তাঁর দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাস কি আজ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত ব্যাপার নয়? চূড়ান্ত সক্ষমতার সাথে সমস্যাসংকুল একটি দেশ ১০ বছর ধরে পরিচালনা করা মোটেও সহজ ব্যাপার নয়। উপরন্তু, দেশকে উন্নয়ন এর একটি দ্রুতগতিসম্পন্ন ট্রেনে সমাসীন রাখার জন্য বিশেষ দক্ষতা ও প্রচেষ্টার প্রয়োজন। বাংলাদেশের বর্তমান সার্বিক উন্নয়ন সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশ এবং তাঁর নেতৃত্ব এর মাধ্যমে বিশ্বের অনেক নেতাকে ছাড়িয়ে গেছেন।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু তাঁর দৃঢ় অঙ্গীকার ও আত্মবিশ্বাস দিয়ে সারা বিশ্বকে বিমোহিত করেছিলেন। তাইতো তিনি বিশ্বের সংগ্রামী ও নির্যাতিত মানুষের নায়কে পরিণত হয়েছিলেন। তাঁর কন্যা কি পিছিয়ে আছেন? বিশ্বের বোদ্ধা ও পন্ডিতরা শেখ হাসিনার ভূঁয়সী প্রশংসা করছেন। বিশ্বমিডিয়ার দৃষ্টিতে শেখ হাসিনা অন্যতম শক্তিশালী ও প্রভাবশালী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। শেখ হাসিনার এ অর্জনগুলোর মাধ্যমে কি বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের মর্যাদা বাড়েনি? এর মাধ্যমে কি বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি সমুজ্জল হয়নি? উল্লিখিত প্রশ্নসমূহের জবাবে শেখ হাসিনার কঠিন সমালোচকরাও কোন নেতিবাচক উত্তর দিতে পারবেন না।
তবে, শেখ হাসিনা কি কেবল দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাস এর প্রতিমূর্তি? তিনি মহানুভবতার দৃষ্টান্ত হিসেবেও কি বিশ্বের অনেক নেতাকে ছাড়িয়ে যাননি? প্রায় ১০ লাখ অসহায় ও হতভাগ্য রোহিঙ্গার কী দশা হতো যদি শেখ হাসিনা ভূমি সংকটে ভোগা এ বাংলাদেশে তাঁদের জন্য আশ্রয় ও সহায়তার ব্যবস্থা না করতেন? সততা ও শক্তিশালী নৈতিকতার কারণে শেখ হাসিনাকে কখনও কখনও কিছুটা কঠোর মনে হয়। সুচারুভাবে দেশ পরিচালনায় কিছুটা কাঠিন্যের প্রয়োজন আছে বৈকি? তবে সাধারণ মানুষের জন্য তাঁর অপরিসীম ভালোবাসা এবং দুর্দশাগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের জন্য তাঁর অতুলনীয় মমত্ববোধ কি তাঁকে মানবতার অন্যতম আলোকবর্তিকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেনি?
এটি বিশ্বাস করা মোটেও অমূলক হবে না যে, বাংলাদেশের সচেতন জনগণ অবশ্যই ধ্বংসের পরিবর্তে উন্নয়নকে বেছে নেবেন এবং স্থিতিশীলতাকে বেছে নেবেন নৈরাজ্যের পরিবর্তে কেননা নৈরাজ্য ফিরে আসার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে যদি স্বাধীনতাবিরোধী ও প্রতিক্রিয়াশীলদের দ্বারা গঠিত জোট ক্ষমতায় ফিরে আসার সুযোগ পায়। এটি এখন ঐতিহাসিক সত্য যে, সে চক্রটি যখনই ক্ষমতায় এসেছে তখনই খলনায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে এবং দেশে অনুন্নয়নের কালো ছায়া নেমে এসেছে। অতএব এ আশাবাদ রাখতে চাই যে, দেশবাসী আসন্ন নির্বাচনে ভোট প্রদানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সুবিবেচনার স্বাক্ষর রাখবেন।
লেখক পরিচিতি: প্রফেসর, লোকপ্রশাসন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি।