৫০ কিমি সাইকেল চালিয়ে ক্লাস করা সাকলায়েনের উত্থান ছিল সংগ্রামমুখর

অনলাইন ডেস্ক

২০২১ সালের ১৩ জুন ঢাকা বোট ক্লাবে গিয়ে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ আনেন চলচ্চিত্র নায়িকা পরীমণি। এর পরদিন উত্তরার একটি বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় ব্যবসায়ী নাসির ইউ মাহমুদকে। পরে ওই ঘটনায় পরীমণিকে গোয়েন্দা কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করে গোয়েন্দা পুলিশ। ওই মামলার তদন্ত তদারক ছিলেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তৎকালীন গোয়েন্দা গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) গোলাম সাকলায়েন শিথিল।

- Advertisement -

তদন্ত করতে গিয়ে চলচ্চিত্র নায়িকা পরীমণির সঙ্গে পরিচয় হয় সাবেক এ পুলিশ কর্তার। এরপর থেকে শুরু হয় নিয়মিত যোগাযোগ। সেই যোগাযোগের সূত্র ধরে তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল প্রেমের সম্পর্ক। পরীমণির বাসায় যাতায়াত শুরু করেন সেই পুলিশ কর্মকর্তা। মাঝেমধ্যে গাড়ি নিয়ে বের হতেন দুজনে। বিবাহিত সেই পুলিশ কর্মকর্তা নিজেকে পরিচয় দিয়েছিলেন অবিবাহিত হিসেবে।

- Advertisement -google news follower

২০২১ সালের ১ আগস্ট পূর্বপরিকল্পনা ও সম্পূর্ণ জ্ঞাতসারে স্ত্রী না থাকা অবস্থায় নায়িকা পরীমণিকে তার রাজারবাগের সরকারি বাসায় নিয়ে যান গোলাম সাকলায়েন। সেখানে তারা প্রায় ১৭ ঘণ্টা অবস্থান করেন। পরদিন ২ আগস্ট রাত দেড়টায় বাসা ত্যাগ করেন। তার ও নায়িকা পরীমণির সম্পর্কের বিষয়টি বিভিন্ন অনলাইন ও প্রিন্ট মিডিয়ায়, টেলিভিশনে ও বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার পর আলোচনায় আসে।

পরবর্তীতে পরীমণিকে গ্রেপ্তারের পর অকপটে স্বীকারও করেন সবকিছু। বিষয়টি টক অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হওয়ায় আলোচিত এই পুলিশ কর্মকর্তাকে ডিবি থেকে বদলি করা হয়। দীর্ঘ তদন্ত, জিজ্ঞাসাবাদ, তথ্য-প্রমাণ ও সাক্ষ্যে পরীমণির বাসায় নিয়মিত রাত্রিযাপন করা ও স্ত্রীর অবর্তমানে রাজারবাগের সরকারি বাসভবনে নিয়ে ১৭ ঘণ্টা অবস্থানের প্রমাণ পায় তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

- Advertisement -islamibank

সেই তদন্তের পরিপ্রেক্ষিতে চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর সুপারিশ করা হয় তৎকালীন ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশের এডিসি (গুলশান) ও বর্তমানে ঝিনাইদহ জেলার ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গোলাম সাকলায়েনকে।

গত ১৩ জুন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের শৃঙ্খলা-২ শাখার উপসচিব পারভীন জুঁই স্বাক্ষরিত স্মারকে বিভাগীয় মামলায় তাকে চাকুরি থেকে ‘বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান’ গুরুদণ্ড প্রদানের বিষয়ে সরকারি কর্ম কমিশন সচিবালয়ের সচিবকে অনুরোধ করা হয়েছে।

কে এই গোলাম সাকলায়েন শিথিল?

৩০তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে প্রথম হয়েছিলেন তিনি। যোগ দেওয়ার পর পুলিশ একাডেমিতে বুনিয়াদী প্রশিক্ষণেও হয়েছিলেন সেরা, পেয়েছিলেন বেস্ট প্রবেশনারি অ্যাওয়ার্ড, বেস্ট অ্যাকাডেমিক এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড। পেশাগত দক্ষতা বাড়িয়ে নিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মাস্টার্স অব পুলিশ সায়েন্সেও হয়েছিলেন প্রথম। পেশাগত দক্ষতার জন্য তিনি যে আরও অনেক পুরস্কার পাবেন, সেটিও ছিল অনুমিত। সর্বশেষ সাহসিকতা ও দক্ষতার স্বীকৃতি হিসেবে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে যে পদক বিতরণ করা হয়েছে, তাতেও স্বাভাবিকভাবেই ছিল তার নাম। পেয়েছেন রাষ্ট্রপতির পুলিশ পদক (পিপিএম)।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে পিপিএম পদকও গ্রহণ করেন গোলাম সাকলায়েন। ডিএমপির গোয়েন্দা (উত্তর) শাখার অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হিসেবেও কর্মরত ছিলেন।

ডিবি সূত্রে জানা গেছে, দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার ও বন্দুকযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ কাজ ও অসীম সাহসিকতার জন্যই তাকে এসব পদক দেওয়া হয়।

সাকলায়েনের স্ত্রীও প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা। পরীমণির সঙ্গে অন্তরঙ্গ সময়কালে(২০২১ জুলাই) ঢাকার পার্শ্ববর্তী একটি জেলায় তার স্ত্রী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাদের একটি সন্তানও রয়েছে।

জীবনের একটা পর্যায়ে এসে এমন সাফল্য আর স্বীকৃতি একের পর এক ধরা দিলেও গোলাম সাকলায়েনের জীবনের উত্থানের পথ এতটা মসৃণ ছিল না। রাজশাহীর চারঘাট উপজেলায় পদ্মার পাড়ে মোক্তারপুর গ্রামে জন্ম নেওয়া সাকলায়েনের বেড়ে ওঠার গল্পটাও ছিল সংগ্রাম মুখর। সব প্রতিকূলতা জয় করেই আজকের এই অবস্থানে এসে পৌঁছেছেন সাকলায়েন।

পিপিএম পদক পাওয়া গোলাম সাকলায়েন ২০০১ সালে সারদা সরকারি পাইলট অ্যাকাডেমি হাই স্কুল থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ ৪ দশমিক ৬৩ নিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন এসএসসি পরীক্ষায়। জিপিএ-৫ না পাওয়ার আক্ষেপটা ছিল। কিন্তু তার গ্রামের জন্য এটিই ছিল অভাবনীয় ফল। পরে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন রাজশাহী নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজে। কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের কঠিন সংগ্রাম করতে হয়েছে সাকলায়েনকে। মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া সাকলায়েনের বাবা ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার মেরুদণ্ডের সমস্যা থাকায় চিকিৎসার পেছনে খরচ হতো অনেক অর্থ। সাকলায়েনকে তাই রাজশাহীতে মেসে রেখে পড়ানোর সামর্থ্য ছিল না পরিবারের। প্রতিদিন ৫০ কিলোমিটার সাইকেলে করে চারঘাট থেকে রাজশাহী এসে কলেজে ক্লাস করতেন তিনি।

সবমিলিয়ে এইচএসসির ফলটাও আশানুরূপ ছিল না, পেয়েছিলেন জিপিএ ৩ দশমিক ৮০। এরপর ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। ভর্তি পরীক্ষায় এ বিভাগে প্রথম হয়েছিলেন তিনি। এরপর একটি বিশ্ববিদ্যালয় কোচিং সেন্টারে সাধারণ জ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। পাশাপাশি শুরু করেন টিউশনি। নিজে কখনো প্রাইভেট পড়ার সুযোগ না পেলেও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ছয় বছর পড়িয়েছেন গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষদের সন্তানদের, বিনামূল্যে কিনে দিয়েছেন বই। তার পড়ানো প্রায় ৫০০ ছেলে-মেয়ে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছেন।

সাকলায়েন চতুর্থ বর্ষ ফাইনাল পরীক্ষার পর ফল পাওয়ার আগেই ‘অবতীর্ণ’ বা ‘অ্যাপিয়ার্ড’ হিসেবে আবেদন করেন ৩০তম বিসিএসে। কিছু না বুঝেই প্রথম চয়েজ দিয়েছিলেন পুলিশ ক্যাডার। পরবর্তীতে প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষায় পাস করেন সাকলায়েন। ৩০তম বিসিএসের কার্যক্রম যখন চলছে, এরই মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের পরীক্ষায় প্রথম হন সাকলায়েন। একই সঙ্গে পরীক্ষা দিয়ে সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবেও টিকে যান, যোগ দেন সেই চাকরিতে। পোস্টিং হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জে। সে অবস্থায় অংশ নেন ৩০তম বিসিএসের ভাইভা পরীক্ষায়। কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন সে পরীক্ষায়।

এরপর শুরু সারদা পুলিশ একাডেমিতে বুনিয়াদী প্রশিক্ষণ। মন দিয়েই নিয়েছেন প্রশিক্ষণ, মেধা আর পরিশ্রম দিয়ে যোগ্যতা প্রমাণ করে তাতে হয়েছেন প্রথম। বেস্ট প্রবেশনারি অ্যাওয়ার্ডের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করে পরে পেয়েছেন বেস্ট অ্যাকাডেমিক এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড। বিভাগের সবার পরামর্শে পেশাগত দক্ষতার তাত্ত্বিক জ্ঞান বাড়িয়ে নিতেই একসময় ফের ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে, পুলিশ সায়েন্সে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিতে। তাতেও প্রথম হন তিনি।

চীনের একটি প্রবাদ— ‘হার্ডওয়ার্ক সাপোর্টেড বাই গুড ইনটেনশন মেকস মিরাকল’। এই প্রবাদটিকেই অনুপ্রেরণা হিসেবে নিয়েছিলেন গোলাম সাকলায়েন শিথিল। কিন্তু সমালোচিত অভিনেত্রী পরীমণির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে দেশব্যাপী সমালোচনার মুখে পড়ে ডিবি থেকে ডিএমপির পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্টে (দাঙ্গা দমন বিভাগ, পশ্চিম) বদলি হন এ পুলিশ কর্মকর্তা। এছাড়া সাকলায়েনের বিরুদ্ধে করা হয় তদন্ত কমিটি।

দীর্ঘ তদন্তে ঘটনার সত্যতা ও তার আত্মপক্ষ সমর্থনে দেওয়া বক্তব্য সন্তোষজনক না হওয়ায় তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

গত ১৩ জুন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের শৃঙ্খলা-২ এর ওই স্মারকে বলা হয়েছে, গোলাম সাকলায়েন পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হয়েও সরকারি দায়িত্বের বাইরে নায়িকা পরীমণির সঙ্গে অতিমাত্রায় ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। তিনি বিবাহিত ও এক সন্তানের জনক হওয়া সত্ত্বেও পরীমণির সঙ্গে তার বিবাহবহির্ভূত অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন, পরীমণির সঙ্গে জন্মদিন উদযাপন ও নিজের সরকারি বাসভবনে সময় কাটানোর মতো ঘটনা বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে প্রচারিত হওয়ায় সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। উল্লিখিত অভিযোগে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়।

জেএন/এমআর

KSRM
পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জয়নিউজবিডি.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন news@joynewsbd.com ঠিকানায়।

এই বিভাগের আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ

×KSRM