ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যাকাণ্ডের পর প্রায় দুই মাস পেরিয়ে গেলেও জট খুলতে পারেনি বাংলাদেশ ও ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা।
এখনো জানা যায়নি হত্যার সঠিক কারণ। ঘটনার সুস্পষ্ট ও উল্লেখযোগ্য তেমন অগ্রগতি নেই। দুই মাস পর এসে সামগ্রিক তদন্তও অনেকটা স্তিমিত হয়ে পড়েছে। সংসদ সচিবালয়কেও এখন পর্যন্ত ‘যথাযথ কর্তৃপক্ষ’ কিছু জানায়নি।
স্বর্ণের চোরাচালানের দ্বন্দ্বেই তিনি ‘খুন’ হয়েছেন বলে শুরু থেকেই আলোচনায় এলেও সময়ের ব্যবধানে সেই আলোচনাও এখন আড়ালে।
আইনের দৃষ্টিতে সবচেয়ে বড় যেই প্রশ্নটি এখনো অমীমাংসিত, সেটি হচ্ছে—আনার কি নিখোঁজ? নাকি হত্যার শিকার? যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, ‘আমরা নিশ্চিত হয়েছি, তাকে হত্যা করা হয়েছে।’
গ্রেফতারকৃতদের বয়ানের ভিত্তিতে ভারতের কলকাতায় উদ্ধারকৃত হাড়গোড়ের সঙ্গে এমপি আজীমের মেয়ের ডিএনএ টেস্ট এখনো করা হয়নি। তার মেয়েকে এখনো পাঠানো হয়নি কলকাতায়। বাংলাদেশে সর্বশেষ গ্রেফতার করা দুই কিলার ফয়সাল ও মোস্তাফিজকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গত ২৩ মে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘আনোয়ারুল আজীম আনারকে যারা হত্যা করেছে, তাদের চিহ্নিত করার প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। শুধু ঘোষণা বাকি। ঘোষণাটি দেওয়া হবে দুই দেশের গোয়েন্দারা সম্পূর্ণ একতম হতে পারলে।’
এই বক্তব্যের সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ-ও যুক্ত করেন, ‘এখন পর্যন্ত নতুন কিছু আমাদের কাছে আসেনি। আমাদের পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশ—দুই দেশ থেকেই আমরা কাজ করছি; যাতে আরও কিছু তথ্য বেরিয়ে আসে।
আমরা নিশ্চিত হয়েছি, তাকে হত্যা করা হয়েছে। যারা হত্যা করেছে, তাদের মুখ থেকে আমরা এগুলো শুনেছি।’
আরেক দিন সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমরা কখনো বলিনি যে, স্বর্ণ নিয়ে দ্বন্দ্বে এমপি আজীম খুন হয়েছেন।’
আনোয়ারুল আজীম আনার কলকাতায় ‘খুন’ হয়েছেন বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হলেও এ ব্যাপারে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানে না সংসদ সচিবালয়।
যার কারণে, গত ৫ জুন সংসদের বাজেট অধিবেশনের প্রথম বৈঠকে তার জন্য শোক প্রস্তাব আনা হয়নি। আজীমের মরদেহের সন্ধান এখনো পাওয়া না যাওয়ায় এবং এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু না জানানোর কারণে তার আসন শূন্য ঘোষণার বিষয়েও এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি সংসদ সচিবালয়।
জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এর আগে ইত্তেফাককে বলেছেন, ‘সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমের বিষয়ে সংসদ সচিবালয়কে এখনো কোনো কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি।
যথাযথ কর্তৃপক্ষ থেকে মৃত্যুসনদ কিংবা অফিশিয়ালি অবহিত হওয়ার পর এ ব্যাপারে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’
প্রসঙ্গত, সংসদের কার্যপ্রণালিবিধি অনুযায়ী কোনো সংসদ সদস্য স্পিকারের অনুমতি ছাড়া টানা ৯০ কার্যদিবস সংসদের বৈঠকে অনুপস্থিত থাকলেও তার সংসদ সদস্যপদ শূন্য হয়ে থাকে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান খুনের বিষয়টি নিশ্চিত করলেও এখন পর্যন্ত তার মরদেহ পাওয়া যায়নি। কলকাতার পুলিশও এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি।
উল্লেখ্য, কোনো সংসদ সদস্য মারা গেলে কিংবা অন্য কোনো কারণে কেউ সংসদ সদস্য পদ হারালে সংবিধান ও কার্যপ্রণালিবিধি অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট আসনটি শূন্য ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করে সংসদ সচিবালয়।
আসন শূন্য ঘোষণা করে গেজেটের বিষয়টি নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) জানায় সংসদ সচিবালয়। শূন্য ঘোষণার ৯০ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট আসনে উপনির্বাচন আয়োজনেরও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
সাম্প্রতিক অতীতে ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর গাইবান্ধা-১ আসনের সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন নিজ বাড়িতে খুন হন।
এর আগে আহসান উল্লাহ মাস্টার সংসদ সদস্য থাকাবস্থায় খুন হন। তাদের মরদেহ নিয়ে কোনো প্রশ্ন বা অনিশ্চয়তা ছিল না। ফলে মৃত্যুর পর পরই সংসদ সচিবালয় আসন শূন্য ঘোষণা করেছিল।
এমপি আনোয়ারুল আজীম গত ১২ মে চিকিৎসার জন্য ব্যক্তিগত সফরে ভারতের কলকাতায় যান। ১৭ মে থেকে পরিবারের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকেন। পরদিন তার নিখোঁজের বিষয়ে উত্তর কলকাতার বরানগর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন এমপি আনারের সেখানকার বন্ধু গোপাল বিশ্বাস।
এরপর সংসদ সদস্যের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন ঢাকায় ডিবির কাছে বাবার নিখোঁজের বিষয়টি জানান।
এদিকে, আনোয়ারুল আজীমের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ও ব্যাংক হিসাব পরিচালনায় আইনি জটিলতা এড়াতেও তার মৃত্যুর বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত হতে হবে।
আজীমকে হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণ মামলায় ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবুসহ তিন জন তাদের আইনজীবীর মাধ্যমে জবানবন্দি প্রত্যাহারের আবেদন করেছেন।
এ ঘটনায় তদন্তে কোনো বাধাগ্রস্ত হবে না বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।
গতকাল শনিবার মিন্টো রোডের নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। জবানবন্দি প্রত্যাহারের আবেদন করা অন্য দুজন হলেন শিমুল ভুঁইয়া ওরফে শিহাব ওরফে ফজল মোহাম্মদ ভুঁইয়া ওরফে আমানুল্যাহ সাঈদ ও তানভীর ভুঁইয়া।
তিন জন আসামি জবানবন্দি প্রত্যাহার করতে চেয়েছেন। এতে মামলায় কোনো প্রভাব পড়বে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে হারুন বলেন, আদালতে যে কেউ আবেদন করতে পারেন। আদালত গ্রহণও করতে পারেন আবার বাতিলও করতে পারেন। এতে তদন্তে কোনো বাধাগ্রস্ত হবে না।
তিনি বলেন, আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এ পর্যন্ত সাত জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সাত জনের মধ্যে ছয় জন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। এছাড়া ভারতীয় পুলিশের কাছে দুই জন আছেন।
ডিবিপ্রধান আরও বলেন, ‘আগেও আমরা বলেছি অযথা কাউকে ডাকাডাকি করছি না। আবার এ ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত, সে যত বড় নেতাই হোক, কাউকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। আরও বেশ কয়েক জনের নাম আমরা পেয়েছি। এর মধ্যে মাস্টারমাইন্ড দেশের বাইরে রয়েছে। সবকিছু মিলিয়েই তদন্ত কার্যক্রম চলছে। ভারতের সঙ্গেও যোগাযোগ রয়েছে আমাদের।’
তিনি বলেন, ‘এমপি আনারের ঘটনায় অবাধ ও সুষ্ঠু তদন্ত করছে ডিবি। তদন্তের প্রয়োজনে আমরা কলকাতা ও নেপালেও গিয়েছি। আদালতের অনুমতি নিয়ে গ্যাস বাবুকে সঙ্গে নিয়ে ঝিনাইদহের দুটি পুকুরে মোবাইল উদ্ধারে অভিযান চালানো হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আনার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আওয়ামী লীগের নেতাসহ ইতিমধ্যে ৯ জন গ্রেফতার হয়েছে। এর মধ্যে দুই জনকে গ্রেফতার করেছে কলকাতা সিআইডি। বাংলাদেশে গ্রেফতার সাত জনের মধ্যে ছয় জন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন।
এছাড়াও হত্যাকাণ্ডের মূল মাস্টারমাইন্ড আমেরিকায় অবস্থান করা আক্তারুজ্জামান শাহিনকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’
জেএন/পিআর