বাংলাদেশে রাজনীতি করলেও তিনি পাপুয়া নিউগিনির শীর্ষ ধনী। বড় ব্যবসায়ী হিসেবে সেখানকার নাগরিকত্ব পেয়েছেন অনেক আগেই। ওশেনিয়া অঞ্চলের দেশটিতে তার মালিকানায় আছে বড় বড় দেড় ডজন কোম্পানি। প্রতিবেশী অস্ট্রেলিয়াসহ আশপাশের কয়েকটি দেশেও এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বিস্তৃত।
‘মহাসম্পদশালী’ এই ব্যক্তির নাম এম এ ওয়াহেদ। তিনি ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। দ্বাদশ সংসদের বিতর্কিত নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ময়মনসিংহ-১১ আসনের সংসদ সদস্য হয়েছিলেন।
শুধু পাপুয়া নিউগিনি নয়, বাংলাদেশেও অঢেল সম্পদের মালিক এই ওয়াহেদ। দখল করেছেন বন বিভাগসহ সরকারের বিপুল পরিমাণ জমি। সব মিলিয়ে দেশ-বিদেশে কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক তিনি।
তথ্য বলছে, এক দশক ধরে পাপুয়া নিউগিনিতে একের পর এক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়েছেন ওয়াহেদ। কৃষি এবং খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবসায় শীর্ষে অবস্থান করছেন তিনি। এ ছাড়া বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে তুলেছেন কৃষি খামার। পাশাপাশি প্রতিনিয়ত বিনিয়োগ করছেন নতুন নতুন খাতে। এর মধ্যে রপ্তানিমুখী নানা পণ্য, নির্মাণ এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতও রয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, পাপুয়া নিউগিনিতে ওয়াহেদের মূল কোম্পানির নাম দেশ বেশ এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড (ঠিকানা-পোস্ট বক্স ২৬২, বোরোকো, ন্যাশনাল ক্যাডর্টাএল ডিস্ট্রিক্ট, পাপুয়া নিউগিনি)। এই প্রতিষ্ঠানের প্রোফাইল ঘেঁটে দেখা যায়, এর আওতাধীন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে গর্ডনস-সেন্ট্রাল সুপার মার্কেটে ক্যাশ অ্যান্ড ক্যারি, সার্ভিস স্টেশন, টু এক্স বেকারি, টু এক্স ফাস্ট ফুড; গর্ডনসে গর্ডন হোলস অ্যান্ড ডেলিভারি ডিপো; দেশ বেশ হোলসেল অ্যান্ড রিটেইল ফাস্ট ফুড বেকারি এবং ফ্রিজার ডিপার্টমেন্ট স্টোর; লয়েস রোডে হোলসেল অ্যান্ড রিটেইল ফাস্ট ফুড, বেকারি অ্যান্ড ফ্রিজার ডিপার্টমেন্ট স্টোর, কৌরা ওয়ে টোকাররায় ক্যাশ অ্যান্ড ক্যারি, ফাস্ট ফুড এবং বেকারি; ফ্রিজার, কনটেইনার ইয়ার্ড, পরিবহন, লজিস্টিক এবং ওয়ার্কশপ; সোগেরি রোডে নতুন প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে পোলট্রি মাংস প্রক্রিয়াকরণ, ফিড মিল, সার প্যাকেজিং, ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট, এগ্রো-সুপার মার্কেট, সবজি ও ফলচাষ এবং মাছচাষসহ কৃষিকাজ।
এ ছাড়া বি পি এক্সপার্ট লিমিটেড, কনকর্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেড, দেশ বেশ এগ্রো কমপ্লেক্স লিমিটেড, গর্ডনস হোলসেল লিমিটেড, রিগস ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন (পিএনজি) লিমিটেড, দেশ বেশ ফার্মেসি লিমিটেড এবং কেসি দ্য স্নেক পিট লাউঞ্জ নামে প্রতিষ্ঠানের মালিকও এম এ ওয়াহেদ।
তথ্য বলছে, পাপুয়া নিউগিনির রাজধানী পোর্ট মোর্সবি ছাড়াও দেশের আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শহরে এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম রয়েছে। এ ছাড়া পাপুয়া নিউগিনির পার্শ্ববর্তী দেশ অষ্ট্রেলিয়ায়ও ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছেন ওয়াহেদ।
পাপুয়া নিউগিনিতে ওয়াহেদের কোম্পানিতে কাজ করেন—এমন একজন কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ হয় গণমাধ্যমের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি জানান, পাপুয়া নিউগিনির অন্যতম শীর্ষ কোম্পানি দেশ বেশ এন্টারপ্রাইজ। নানা খাতে এই কোম্পানির বিনিয়োগ রয়েছে। বর্তমানে শুধু পাপুয়া নিউগিনিতেই এক হাজারের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করেন।
জানা গেছে, ওয়াহেদ অনেক আগেই পাপুয়া নিউগিনির নাগরিকত্ব নিয়েছেন। সে দেশের পাসপোর্টও রয়েছে তার, যার নম্বর ই-২২৯৫২৩। এ ছাড়া ইন্দোনেশিয়ার পাসপোর্টও রয়েছে তার। তবে সেসব তথ্য গোপন করে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন তিনি। হলফনামায় তিনি নিজেকে শুধু বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে উল্লেখ করেন। তার জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর ৮৬৭২৩৬৯৫৫৩। পাসপোর্ট নম্বর এ-০৩৩০৭৬৩২।
তবে পাপুয়া নিউগিনির বহুল প্রচলিত ইংরেজি দৈনিক পোস্ট কুরিয়ারে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশটির নাগরিকত্ব নিয়েছেন ওয়াহেদ। ওই পত্রিকায় ওয়াহেদকে ‘বিজনেস টাইকুন’ আখ্যায়িত করে একটি ফিচার প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয়, ওয়াহেদ পাপুয়া নিউগিনির একজন শীর্ষ ব্যবসায়ী। নানা খাতে তার বিনিয়োগ রয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার পার্শ্ববর্তী দ্বীপরাষ্ট্রে এম এ ওয়াহেদের বিপুল সম্পদের উৎস নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। দেশে অর্জিত অবৈধ অর্থ পাচার করে বিদেশে সম্পদ গড়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে গত মার্চে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) আবেদনও জমা হয়েছিল। তবে সেই সময় দুদক কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
শুধু বিদেশেই নয়, দেশেও বিপুল পরিমাণ সম্পদ গড়েছেন। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের ২ নম্বর রোডে আলিফ টাওয়ার নামে একটি বাড়ি, ৯ নম্বর হোল্ডিংয়ে ১০ কাঠা জমির ওপর বহুতল ভবনসহ আরও তিনটি বাড়ি রয়েছে। উত্তরার ৭ নম্বর সেক্টরে একটি বাড়ি, আশুলিয়ায় একটি কারখানা রয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে ভালুকা বাজারে ২৯ শতাংশ ভূমির ওপর ১৪তলা বিশিষ্ট ওয়াহেদ টাওয়ার নামে বিশাল একটি ভবন রয়েছে। ভালুকার আঙ্গারগাড়া গ্রামে তিন বিঘা জমির ওপর দ্বিতল বিশিষ্ট সুইমিংপুলসহ একটি বাড়ি, পাঁচ বিঘা জমির ওপর তিন তলাবিশিষ্ট একটি বাড়ি এবং আঙ্গারগাড়া গ্রামে তিন বিঘা জমির ওপর দ্বিতল বিশিষ্ট সুইমিংপুলসহ একটি বাড়ি, পাঁচ বিঘা জমির ওপর তিন তলাবিশিষ্ট একটি বাড়ি এবং আঙ্গারগাড়া বাজারে দুটি ৫তলা বিশিষ্ট এবং একটি তিন তলাবিশিষ্ট বাড়ি রয়েছে। ময়মনসিংহ শহরের কৃষ্টপুর বিদ্যুৎ কোয়ার্টার সংলগ্ন ৩১ শতাংশ জমি রয়েছে। চরপাড়া এলাকায় রয়েছে ৬২ শতাংশ জমি।
সরেজমিন ভালুকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ডাকাতিয়া আংগারগাড়া মৌজায় ৬৫ শতাংশ জমির ওপর ওয়াহেদ ফিড নামের একটি মিল রয়েছে। পাশেই রয়েছে আরও তিনটি ৫তলা ভবন। এ ছাড়া এলাকায় ৩০ একরেরও বেশি জমি রয়েছে ওয়াহেদের। বনের জমি এবং সরকারি খাল দখল করে পুকুর খনন করেছেন তারা। যার এস এ দাগ ২৮৮। পুকুর করা হয়েছে এস এ দাগ ২৮৫। এস এ দাগ ৩৯৩ দখল করেও পুকুর খনন করেছেন ওয়াহেদ। এ ছাড়া এস এ বনের ৩৬৭ নং দাগে বাড়ি নির্মাণ, ৩৯৪ নং দাগের জমি দখল নিয়ে সবজি বাগান করেছেন। ৩০০ নং দাগে সরকারি জমি দখল করে নিজ নামে ভবন করেছেন।
বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, সব মিলিয়ে বাড়ি, ভবন, খাল এবং সবজি বাগানের নামে প্রায় ২০ একর বনের জায়গা দখল করেছেন এমপি ওয়াহেদ। শিল্প এলাকা হিসেবে পরিচিত ভালুকার জমির দাম অনেক। বড় বড় কোম্পানিও এই এলাকায় বনের জায়গা দখল করে কারখানা গড়ে তুলেছে।
তারা বলছেন, অন্তত ত্রিশ থেকে চল্লিশটি কোম্পানি ভালুকার বিভিন্ন এলাকায় বনের জায়গা দখল করেছে। আর এসবের পেছনে রয়েছেন এমপি ওয়াহেদ। এসব নিয়ে বন কর্মকর্তারা প্রশ্ন তোলার সাহসও রাখেন না। কারণ, প্রশ্ন তুললেই বদলি হয়ে যেতে হয়।
তবে আংগারগাড়া বিট কর্মকর্তা মাজহার ইসলাম বলেন, দখলের বিষয়ে আমি জানি না। কেউ অভিযোগ দিলে খবর নিয়ে দেখতে পারব। আসলেই দখলে নিয়েছে কি না।
এসব বিষয়ে জানতে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় এম এ ওয়াহেদের সঙ্গে। তার বাড়িতে গেলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে সূত্র বলছে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালেই দেশ ছাড়েন ওয়াহেদ। বর্তমানে তিনি পাপুয়া নিউগিনিতেই রয়েছেন। তার ব্যবহৃত হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরটিও বন্ধ রয়েছে।
জেএন/এমআর