দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতি-অনিয়মের পাহাড় সমান অভিযোগ থাকলেও এখনো স্বপদে বহাল আছেন চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ কে এম ফজলুল্লাহ।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সারাদেশের বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে যখন সংস্কার করা হচ্ছে,ঠিক সে সময়েও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে টানা ৬ দফায় ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে চট্টগ্রাম ওয়াসার গুরুত্বপূর্ণ পদটি দখলে রয়েছে তার।
তবে এ নিয়ে গেল কয়েকদিন ধরেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনার ঝড় উঠেছে। অবশেষে আজ রোববার (১ সেপ্টেম্বর) সকাল ১১টার দিকে এমডি’র কার্যালয়ে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন শুরু করেছেন বৈষম্যবিরোধী সাধারণ নাগরিক সমাজ নামে একটি সংগঠন।
তাকে প্রায় এক ঘণ্টা তাঁর কক্ষে অবরুদ্ধ করে এমডি পদ থেকে পদত্যাগ ও শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ করেছে সংগঠনটির কর্মীরা। এ সময় ভোক্তাদের জাতীয় সংগঠন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন এবং চট্টগ্রাম নগর কমিটির নেতৃবৃন্দরাও উপস্থিত ছিলেন।
সংগঠনের নের্তৃবৃন্দরা এমডিকে ‘নিজ উদ্যোগে পদত্যাগ না করলে হেনস্তার শিকার হবেন বলেও হুঁশিয়ারি দেন। তাছাড়া ১৭টি দাবি তুলে ধরেন আন্দোলনকারীরা।
দাবিগুলো হলো
এমডি ফজলুল্লাহ’র আয়কর বিবরণী ২০০৯-২০২৪ এবং সম্পদ বিবরণী জনসম্মুখে প্রকাশ।
ভ্রমণ বিল (২০০৯-২০২৪) এর পূর্ণাঙ্গ তথ্য প্রকাশ এবং ভ্রমণ বিলকে ব্যবসায় পরিণত করায় অনতিবলম্বে তা সরকারি কোষাগারে জমা করা।
অবিলম্বে স্বৈরচারী সরকারের পোষ্যদের নিয়ে গঠিত বোর্ড বাতিল।
চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রকৌশল ও রাজস্ব শাখাকে ঢেলে সাজানো। দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা/কর্মচারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা
৪ আগস্ট স্বৈরাচারী সরকারের পক্ষ নিয়ে তাণ্ডবে অংশ নেওয়া ওয়াসার কর্মচারীদের চিহ্নিত করে স্থায়ী বহিষ্কার করা।
সরকার পতনের পর এমডির দেওয়া সকল অবৈধ অফিস আদেশ বাতিল।
ফজলুল্লাহ’র সময়ে বহিষ্কৃত সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরিতে পুনর্বহাল করা।
যে সকল কর্মকর্তা প্রাধিকারের বাইরে গাড়ি ও জ্বালানি ভোগ করছেন তা সরকারি কোষাগারে জমা করা।
যে সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী অধিক ৫ বছর একই কর্মস্থলে কর্মরত তাদের দ্রুত বদলি করা।
বিগত সরকারের আমলে সমাপ্ত ও চলমান প্রকল্পের নথি-অডিট সংক্রান্ত তথ্য ও সমস্ত ক্রয়ের হিসাব জনসম্মুখে প্রকাশ করা।
চট্টগ্রাম ওয়াসা রেস্ট হাউজের বিদ্যুৎ বিল, পানির বিল, গ্যাসের বিল (২০০৯-২০২৪) ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নিজ খাত থেকে পরিশোধ করা।
ব্যারিস্টার কলেজ এলাকায় অবৈধ সংযোগের তদন্ত-ওয়াটার ওয়ার্কসে ভাউচারে পানি বিক্রয়ের টাকা আত্মসাতের তদন্ত প্রতিবেদন সহ ২০০৯ এর পর সংগঠিত অন্যান্য দুর্নীতির তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা।
চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রকল্প, রাজস্ব ও রাজস্ব শাখার দুর্নীতি প্রতিরোধে স্থানীয় সরকার বিভাগ হতে মনিটরিং সেল চালু করা।
বিক্রয় বিভাগে ১৫ বছর ধরে কর্মরত দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা রিচার্ড নেলসন পিনারুর অনিয়ম তদন্ত করে শাস্তির ব্যবস্থা করা।
উইংস লিমিটেড নামের ঠিকাদার থেকে স্মার্ট মিটার কিনে ‘পদ্মা’ নামে বিল করার রহস্য ও অনিয়ম তদন্ত করে অভিযুক্তদের শাস্তির আওতায় আনা।
বিগত ১০ বছর ধরে ৩০-৩৫ শতাংশ পানি সিস্টেম লস দেখিয়ে বিপুল অর্থ আত্মসাতের সুষ্ঠু তদন্ত করে দায়ীদের শাস্তি দেওয়া এবং
বিগত ১৫ বছরে করোনাসহ নানা সংকটের মধ্যে পানির দাম বাড়িয়ে মানুষের কষ্টের প্রতিকার করা।
আন্দোলনকারীরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অনিয়মের পাহাড় সমান অভিযোগ থাকলেও চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ কে এম ফজলুল্লাহর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই পুনরায় এমডি পদে মেয়াদ বাড়িয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছে।
তাদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবে খাটিয়ে দীর্ঘদিন এমডি পদ দখল করে রেখেছেন এ ব্যক্তি। শেখ হাসিনার শাসনামলে টানা ৬ দফায় নানান লুটপাট জাতির কাছে স্পষ্ট এবং দৃশ্যমান। তাই অতিত্ত্বর নিজ উদ্দ্যেগে এমডি থেকে পদত্যাগ করুন।
পদত্যাগের বিষয়ে ওয়াসার এমডি এ কে এম ফজলুল্লাহ বলেন, আমি সরকার নিযুক্ত লোক, কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব না। কয়েকজন এসে আমার রুমে আন্দোলন করেছে। তারা আমার পদত্যাগ দাবি করেছে।
আজকে তাদের কথায় চলে গেলাম। তখন সরকার আমার থেকে জানতে চাইবে আমি কেন গেলাম। তবে সরকার যেদিন আমাকে বলবেন- আমি তখনই পদত্যাগ করবো।
তাছাড়া আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে দুদক ও বিভিন্ন সরকারি দপ্তর থেকে তা তদন্ত করে কোন দুর্নীতির প্রমাণ পাইনি। দুর্নীতির কোন সুযোগও নেই বললেন ওয়াসার এমডি।
উল্লেখ্য : এ কে এম ফজলুল্লাহ চট্টগ্রাম ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে অবসর নেন ২০০০ সালে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ৬ জুলাই প্রথমবার চট্টগ্রাম ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে এক বছরের জন্য নিয়োগ পান।
এরপর আরও এক বছর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১১ সালে ঢাকা ওয়াসার আদলে চট্টগ্রাম ওয়াসাতেও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ তৈরি করা হয়। ওয়াসা বোর্ডও পুনর্গঠন করা হয়। তখন এমডি পদে নিয়োগ পান তৎকালীন চেয়ারম্যান এ কে এম ফজলুল্লাহ। সেই থেকে এমডি পদে দায়িত্ব পালন করছেন।
সবশেষ গত অক্টোবরে সাতবারের মেয়াদ শেষ হয়েছিল। কিন্তু ওই মেয়াদ শেষ হওয়ার প্রায় দুই মাস আগে তাকে আবার নিয়োগ দিয়েছে সরকার।
তখন স্থানীয় সরকার বিভাগের পানি সরবরাহ শাখার উপসচিব মুস্তাফিজুর রহমান স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ আইন ১৯৯৬-এর ২৮ (২) ধারা মোতাবেক এ কে এম ফজলুল্লাহকে বর্তমান চাকরির মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর থেকে তিন বছরের জন্য চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডি হিসেবে পুনর্নিয়োগ করা হলো। ১ নভেম্বর থেকে তিন বছর দায়িত্ব পালন করবেন তিনি।
জেএন/পিআর