বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের একটি আজন্ম ব্র্যান্ড সালমান শাহ। তাকে বলা হয় বাংলা চলচ্চিত্র জগতের রাজপুত্র। মৃত্যুর ২৮ বছর হয়ে গেছে, অথচ এখনো তার আবেদন ও জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে আরও অনেক বেশি রঙিন হয়েছে সালমান শাহকে নিয়ে ভালোবাসার রং। এখনো টিভির পর্দায় তার সিনেমা প্রচার হলে দর্শক আগ্রহ নিয়ে দেখেন।
ক্ষণজন্মা এই নায়ক রেখে গেছেন ২৭টি চলচ্চিত্র এবং অগণিত ভক্ত। সেই ভক্তের সংখ্যা চক্রবৃদ্ধি হারে শুধু বেড়েছেই দিনে দিনে। রুপালি পর্দায় অভিষেকের পর খুব শিগগিরই সালমান শাহ হয়ে উঠেছিলেন কোটি তরুণ-তরুণীর স্বপ্নের নায়ক। শুরুতেই বিশাল সাফল্য দিয়ে তিনি প্রাণসঞ্চার করে দিলেন মৃতপ্রায় চলচ্চিত্রে। তারপর শুধুই ইতিহাস।
অনেকে বলে থাকেন, সালমান শাহর মতো জনপ্রিয় নায়ক হয়তো আর কখনোই কোনো দিন জন্মাবে না বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে। আজ (শুক্রবার) সেই অমর নায়কের ২৮তম মৃত্যুবার্ষিকী।
চলচ্চিত্রে অভিষেকের আগের বছর অর্থাৎ ১৯৯২ সালের ১২ আগস্ট খালার বান্ধবীর মেয়ে সামিরা হককে বিয়ে করেন সালমান শাহ। সামিরা ছিলেন বিউটি পার্লার ব্যবসায়ী। তিনি সালমান শাহর দুটি চলচ্চিত্রে তার পোশাক পরিকল্পনাকারী হিসেবেও কাজ করেন।
কিন্তু দাম্পত্য জীবনের পাঁচ বছরের মাথায় ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর হঠাৎই সালমান শাহর মৃত্যু খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। এদিন রাজধানীর ইস্কাটনে নিজ বাসার সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় তার মরদেহ পাওয়া যায়। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে এই মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে উল্লেখ করা হলেও নায়কের মৃত্যু নিয়ে দানা বাঁধে রহস্য।
সালমান শাহর মৃত্যুর জন্য অভিযোগের আঙুল ওঠে তার স্ত্রী সামিরার দিকে। পরবর্তীতে সামিরা, চলচ্চিত্র প্রযোজক ও ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মাদ ভাইসহ ১১ জনকে এই মৃত্যুর জন্য দায়ী করে হত্যা মামলা করে সালমান শাহর পরিবার। অন্য অভিযুক্তরা হলেন- সামিরার মা লতিফা হক লুসি, রিজভী আহমেদ ওরফে ফরহাদ, সহকারী নৃত্যপরিচালক নজরুল শেখ, ডেভিড, আশরাফুল হক ডন, রাবেয়া সুলতানা রুবি, মোস্তাক ওয়াইজ, আবুল হোসেন খান ও গৃহকর্মী মনোয়ারা বেগম।
১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সালমান শাহর মৃত্যুর খবরে কার্যত স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল গোটা দেশ। যদিও তার মৃত্যুরহস্য আজও উদঘাটিত হয়নি। ২০২০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পুলিশের তদন্ত বিভাগ জানায়, সালমান শাহ আত্মহত্যাই করেছিলেন। কিন্তু এই প্রতিবেদন মানতে পারেনি সালমান শাহর পরিবার এবং তার অসংখ্য ভক্ত।
এর আগে ১৯৯৬ সালে সালমান শাহর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে সেই শোকে সারা দেশে আত্মঘাতী হন বেশ কয়েকজন তরুণ-তরুণী। তারা সবাই সালমান শাহর অন্ধ ভক্ত ছিলেন। প্রিয় তারকার মৃত্যুর খবরে এভাবে তরুণ-তরুণীদের আত্মাহুতি পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। সেই সালমান শাহ মরেও অমর হয়ে আছেন এ দেশের কোটি কোটি ভক্তের হৃদয়ে।
১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন সালমান শাহ। তার বাবার নাম কমর উদ্দিন চৌধুরী এবং মায়ের নাম নীলা চৌধুরী। তিনি ছিলেন পরিবারের বড় ছেলে। সালমান শাহর জন্মনাম ছিল শাহরিয়ার চৌধুরী ইমন। তবে চলচ্চিত্রে তিনি সবার কাছে সালমান শাহ নামেই পরিচিত ছিলেন।
সালমান শাহ পড়াশোনা করেন খুলনার বয়রা মডেল হাই স্কুলে। ওই স্কুলে চিত্রনায়িকা মৌসুমী তার সহপাঠী ছিলেন। পরে ১৯৯৩ সালে একই সঙ্গে দুজনের চলচ্চিত্রে অভিষেক হয়। সে বছর সালমান-মৌসুমী জুটি বেঁধে অভিনয় করেন সোহানুর রহমান সোহান পরিচালিত ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবিতে।
সেই থেকে একবারের জন্যও পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি সালমানকে। মাত্র চার বছরের ক্যারিয়ারে ২৭টি ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। সেগুলোর প্রায় সবগুলোই সুপারহিট। তার অভিনীত ছবিগুলোর মধ্যে অন্যতম অন্তরে অন্তরে, সুজন সখী, স্বপ্নের নায়ক, স্বপ্নের ঠিকানা, চাওয়া থেকে পাওয়া, জীবন সংসার, প্রেম প্রিয়াসী, সত্যের মৃত্যু নেই, মায়ের অধিকার, এই ঘর এই সংসার, তোমাকে চাই, আনন্দ অশ্রু, বুকের ভেতর আগুন ইত্যাদি।
সালমান শাহর সঙ্গে চিত্রনায়িকা শাবনূরের জুটি ছিল সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তাদেরকে সবচেয়ে সেরা জুটিও বলেন অনেকে। একসঙ্গে ১৪টি ছবি করেছিলেন তারা। প্রতিটিই সুপারহিট। তাদের পর্দার রসায়ন ছিল নজরকাড়া। এ জুটির বাস্তব জীবনের রসায়ন নিয়েও সে সময় তুমুল চর্চা হতো, হয় এখনো।
জেএন/এমআর