• দুই মাসের ব্যবধানে চট্টগ্রাম নগরীতে তিন খুন
• আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজির দ্বন্দ্বের জেরে বাড়ছে হত্যার ঘটনা
• যখন তখন গুলি ছোঁড়ে ভয়ভীতি দেখায় সন্ত্রাসীরা
• তিন হত্যা মামলার আসামি এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে
চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার ছেলে সাজ্জাদ হোসেন। স্থানীয়দের ভয়ভীতি দেখানো, চাঁদাবাজি এসব অভিযোগ তো আছেই, গেলো দু’মাসের ব্যবধানে তার বিরুদ্ধে ৩টি হত্যা মামলা হয়েছে। পুলিশের নাকের ডগায় ঘুরে বেড়ালেও এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে পরপর তিনটি হত্যা মামলার আসামি সাজ্জাদ হোসেন।
টেম্পুর চাঁদাবাজি নিয়ে দ্বন্দ্ব, গুলি করে হত্যা
২১ অক্টোবরের ঘটনা। সেদিন দুপুরে একটি দৈনিক পত্রিকার নিউজ শেয়ার করে আফতাব উদ্দিন তাহসিন (২৬) ফেসবুকে লেখেন, ‘প্রশাসন চুপ কেন? ডাবল মার্ডার হওয়ার দুই মাস হয়ে গেছে একজন আসামিও গ্রেফতার হয় না।’ এরপর বিকেলে ৫টার দিকে একটি দোকানে বসে চা খাচ্ছিলেন তাহসিন। এ সময় প্রতিপক্ষের লোকজন গিয়ে তাকে গুলি করে সটকে পড়ে। গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। জানা গেছে, প্রতিপক্ষ গ্রুপের সাজ্জাদ হোসেনকে গ্রেফতারের দাবি জানিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন তাহসিন। এর তিন ঘণ্টা পরেই গুলিতেই নিহত হন তিনি। নগরের চান্দগাঁও থানার ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের অদূরে বানিয়ারা পাড়ায় এ ঘটনা ঘটে।
স্থানীয়রা বলছেন, সন্ত্রাসী সাজ্জাদ হোসেন ও সরোয়ার হোসেন বাবলা গ্রুপের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিরোধের জেরে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। নিহত তাহসিন বাবলা গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত। তার বিরুদ্ধেও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ আছে। তাহসিন চান্দগাঁও থানার হাজীরপুল এলাকার বাসিন্দা। তার বাবার নাম মো. মুসা।
গুলিতে নিহত তাহসিনের ভাই তানভীর হোসেন অভিযোগ করে বলেন, সাজ্জাদের চাঁদাবাজির কারণে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। তিনি আরও বলেন, ‘সন্ত্রাসী সাজ্জাদ, ভাইয়ার ইট ও বালুর ব্যবসা থেকে চাঁদাও চেয়েছিলেন। এ কারণে দুই মাস আগে আদালতে জিডি করেন আমার ভাই। সন্ত্রাসী সাজ্জাদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে আমার ভাই ফেসবুকে লেখালেখি করতেন। সেই কারণে আমার ভাইকে হত্যা করা হয়েছে।’
স্থানীয়দের ভাষ্য, সন্ত্রাসী সাজ্জাদ হোসেন ও সারোয়ার হোসেন বাবলা আগে একই গ্রুপে নেতৃত্ব দিতো। পরে তাদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হলে দু’টি গ্রুপ তৈরি হয়। চাঁদাবাজি, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়, হত্যা, খুনের চেষ্টাসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি জানান, মূলত হত্যাকাণ্ডটি ঘটে ৩৬টি টেম্পুর চাঁদাবাজি নিয়ে। এসব টেম্পু প্রতিদিন চান্দগাঁও হাজীরপুর থেকে বহদ্দারহাট মসজিদ পর্যন্ত চলাচল করে থাকে। এসব টেম্পু থেকে প্রতিদিন ২০০ টাকা করে চাঁদা আদায় করে একটি গ্রুপ। সরকার পতনের আগে যে গ্রুপ টাকা নিতো তারা পরিবেশ পরিস্থিতিতে হঠাৎ আড়ালে চলে যায়। বর্তমানে ভাগ বাটোয়ারায় নতুন দুই গ্রুপের আধিপত্য বিস্তারে এ খুনের ঘটনা ঘটে।
বায়েজিদে জোড়া খুন
এর আগে গত ২৯ আগস্ট নগরের বায়েজিদ বোস্তামী থানার অনন্যা আবাসিক ও হাটহাজারীর কুয়াইশ এলাকায় প্রকাশ্যে গুলি করে খুন করা হয় মো. আনিস ও মাসুদ কায়সার নামে দুই যুবককে। এ ঘটনায় দায়ের করা পৃথক দুটি মামলায় সাজ্জাদ ও তার সহযোগীদের আসামি করা হয়।
পুলিশ ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা যায়, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে স্থানীয় সারোয়ার বাবলা এবং সাজ্জাদ হোসেন গ্রুপের মধ্যে বিরোধ দীর্ঘদিনের। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে সারোয়ার সাজ্জাদের বিভিন্ন অপকর্মের তথ্য পুলিশকে দেন। গত ১৭ জুলাই চান্দগাঁও থানা-পুলিশ অস্ত্রসহ সাজ্জাদকে গ্রেফতার করে। পরের মাসেই তিনি জামিনে বেরিয়ে আসেন। জামিনে বেরিয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন সাজ্জাদ। সেই বিরোধের জেরে খুন হন মাসুদ ও আনিস নামে দুই যুবক।
নিহত মাসুদ কায়সারের ভাই মো. আরিফ অভিযোগ করে বলেন, আসামিরা এলাকায় প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে ঘুরছে কিন্তু পুলিশ তাদের ধরছে না। এ কারণে এলাকায় একের পর এক ঘটনা ঘটছে।
সাজ্জাদের বিরুদ্ধে আরও যত অভিযোগ
স্থানীয়রা বলছেন, চট্টগ্রামের একসময়ের শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ আলীর সহযোগী হিসেবে এই সাজ্জাদ হোসেন অপরাধ-জগতে পা রাখেন। বায়েজিদ, পাঁচলাইশ, চান্দগাঁও ও হাটহাজারী এলাকায় নতুন বাড়ি নির্মাণ, ব্যবসা-বাণিজ্য, জমি বেচাকেনা করলেই হানা দেন সাজ্জাদ। চাঁদা দিতে গড়িমসি করলেই করা হয় হামলা। বাহিনী নিয়ে যখন তখন গুলি চালিয়ে ভয়ভীতি দেখানো হয়।
সাজ্জাদের বাড়ি হাটহাজারীতে হলেও তার অপরাধ জগত নগরের বায়েজিদ বোস্তামী, চান্দগাঁও, পাঁচলাইশ থানা সংলগ্ন এলাকা। ১৫ থেকে ২০ জনের বাহিনী নিয়ে অস্ত্র নিয়ে দাপিয়ে বেড়ান সাজ্জাদ।
পুলিশের তথ্য বলছে, সাজ্জাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র, চাঁদাবাজির মামলা আছে ১০টি।
কথায় কথায় গুলি ছোড়েন সাজ্জাদ
বায়েজিদ কালারপুল এলাকায় ৬০ জন মিলে একটি ভবন নির্মাণ করছেন। ভবন মালিকদের কাছ থেকে চাঁদা দাবি করেন সন্ত্রাসী সাজ্জাদ। কিন্তু নির্ধারিত সময় চাঁদা না পেয়ে প্রকাশ্য অস্ত্র হাতে নির্মাণাধীন ওই ভবনে গুলি করেন সাজ্জাদ ও তার দলবল। বাধ্য হয়ে ওই ভবন মালিকদের পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দিতে হয়। ভবনটির সিসিটিভির ফুটেজে ধারণ করা ভিডিওতে অস্ত্রবাজির ঘটনাটি ধরা পড়ে।
এর আগে গত ৫ জুলাই বায়েজিদ থানার বুলিয়াপাড়া এলাকায় একটি বাসায় গুলি করেন সাজ্জাদ ও তার সহযোগীরা। জানা গেছে, ওই এলাকায় এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা নেওয়ার প্রতিবাদ করায় সাজ্জাদ ভুক্তভোগীর বাড়িতে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়েন। এ ঘটনায় বায়েজিদ বোস্তামী থানায় মামলা করেন ভুক্তভোগী ইকবাল।
চাঁদা না পেয়ে মো. হাছান নামে এক ঠিকাদারের বাসায়ও গুলি করেন সাজ্জাদ। গত বছরের ২৭ অক্টোবর নগরের চান্দগাঁও হাজীরপুল এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় হাছান বাদী হয়ে চান্দগাঁও থানায় মামলাও করেন।
চট্টগ্রাম নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) আবদুল মান্নান মিয়া বলেন, ‘সন্ত্রাসী সাজ্জাদই তাহসিনকে গুলি করে হত্যা করেছে বলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এর আগেও বেশ কয়েকটি ঘটনায় তার সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। তাকে গ্রেফতারে অভিযান চলছে।’
জেএন/এমআর