হাসিনাকে ফিরিয়ে দেওয়া নিয়ে ভারতকে প্রধান উপদেষ্টার হুঁশিয়ারি

জাতীয় ডেস্ক :

ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মধ্যে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা

- Advertisement -

প্রতিবেশী দেশটিতে বসে তিনি তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

- Advertisement -google news follower

“বিচারের মুখোমুখি করতে হাসিনাকে অবশ্যই ফিরিয়ে দিতে হবে। না দিলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে খুব একটা সুখের সম্পর্ক তৈরি হবে না”— এমন মন্তব্যও করেন প্রধান উপদেষ্টা।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দুকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন ড. ইউনূস।

- Advertisement -islamibank

সোমবার সংবাদমাধ্যমটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয় সাক্ষাৎকারটি। ঢাকায় নিজের বাসভবনে সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়।

সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ইউনূস দুদেশের সম্পর্ক, বাংলাদেশের সংস্কার পরিকল্পনা, অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়ে কথা বলেন।

সরকারের ১০০ দিন পূর্তিতে দেশের আইন-শৃঙ্খলা এবং অর্থনীতি বিষয়ে দ্য হিন্দুর এক প্রশ্নের জবাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “আমরা এখনো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করছি, তবে আমি বলব না যে আমরা এখনই ‘এ’ গ্রেড পেয়েছি।

অন্য ইস্যুতে বলব— অর্থনীতির ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন ‘এ-প্লাস’ কারণ আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে ছিন্নভিন্ন অর্থনীতি পেয়েছিলাম।

সমস্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে। দেশে উন্মত্ত ব্যাংকিং সিস্টেম ছিল। খারাপ ঋণ ছিল, ৬০ শতাংশ অশোধিত ঋণ।

“যদিও অবস্থা এখনও নিখুঁত নয়, তবে অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে” দাবি করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আমরা দায়িত্ব নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গেছে, কিন্তু গত ১০০ দিন ধরে মাসে মাসে এটি বাড়ছে।”

সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা জানান, সরকার ঋণ পরিশোধ করতে সক্ষম হয়েছে এবং এটি দেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি উন্নত করেছে।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার মুদ্রাস্ফীতিকে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনার চেষ্টা করছে উল্লেখ করে নোবেল বিজয়ী এই অর্থনীতিবিদ বলেন, “সর্বোপরি, আমরা প্রচুর পরিমাণে বৈশ্বিক সমর্থন পেয়েছি— আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আমাদের সঙ্গে ব্যবসা করছে, আমাদের আরও সহযোগিতার আশ্বাস দিচ্ছে যাতে বিনিয়োগের দ্বার উন্মোচন করা যায়।”

প্রধান উপদেষ্টা এসময় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠকের ফাঁকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধানসহ অনেক সরকারপ্রধানের সঙ্গে দেখা করার কথা উল্লেখ করেন।

“আরও অনেকের সঙ্গে কথা হয়েছে যারা আমাদের আর্থিক সহায়তা এবং রাজনৈতিক সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন”— বলেন ড. ইউনূস।

যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচিত হওয়া এবং বাংলাদেশ নিয়ে তার ‘সমালোচনার’ বিষয়টি তুলে ধরে নতুন মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সমর্থন অব্যাহত থাকবে কিনা এমন প্রশ্ন এলে ড. ইউনূস দ্য হিন্দুকে স্পষ্ট ভাষায় বলেন, “আমার মনে হয় না ট্রাম্প বাংলাদেশ নিয়ে কোনো বক্তব্য দিয়েছেন।”

“বাংলাদেশ এবং সংখ্যালঘুদের বিষয়ে ট্রাম্প সম্ভবত ভালোভাবে অবহিত নন” বলে মনে করেন ড. ইউনূস।

বলেন, “এটা একটা প্রোপাগান্ডা যা সারা বিশ্বে চলছে। কিন্তু যখন তিনি (ট্রাম্প) বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের বাস্তবতায় আসবেন, তখন অবাক হবেন যে— তাকে যে ধারণা দেওয়া হয়েছে তার থেকে বাংলাদেশ কতটা আলাদা।”

বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক এবং দেশটির পররাষ্ট্র নীতি নিয়ে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ বলেন, “আমি মনে করি না যুক্তরাষ্ট্রে একজন নতুন প্রেসিডেন্ট এসেছেন, মানে সবকিছু বদলে যাবে। প্রেসিডেন্টের পরিবর্তনের কারণে পররাষ্ট্রনীতি এবং দেশ অনুযায়ী সম্পর্ক সাধারণত পরিবর্তিত হয় না।”

তিনি বলেন, “আমরা অপেক্ষা করব এবং যদি মার্কিন প্রতিনিধিরা এসে আমাদের দেখে পরীক্ষা করে এবং যদি দেখে আমাদের অর্থনীতি ভালো চলছে, তারা খুব আগ্রহী হবে।

তারা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সরকারি ক্রেতা, তাই আমাদের দিক থেকে এটি খুব ভালো সম্পর্ক যা আমরা বছরের পর বছর ধরে গড়ে তুলেছি। আমাদের আশা, এটা আরও জোরদার হবে।”

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ভারত সরকার সম্প্রতি বেশ কয়েকটি বিবৃতি দিয়েছে। এ বিষয়ে ড. ইউনূস বলেন, “প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে আমার প্রথম ফোন কলে (১৬ আগস্ট) তিনি ঠিক এটাই বলেছিলেন— বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা হচ্ছে ইত্যাদি।

আমি তাকে খুব স্পষ্টভাবে বলেছি, এটা প্রোপাগান্ডা। অনেক সাংবাদিক এখানে আসার পরে, কিছু উত্তেজনা সম্পর্কে কিছু প্রতিবেদন এসেছে, তবে মিডিয়াতে যেভাবে বলা হয়েছে পরিস্থিতি তেমন নয়। এই প্রচার-প্রোপাগান্ডা বাস্তবতার সঙ্গে যায় না।

দ্য হিন্দুর পক্ষ থেকে প্রশ্ন করা হয় সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে কমিশন না করার বিষয়ে। এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার স্পষ্ট কথা, “আমাদের মানবাধিকার কমিশন আছে এবং কেন সংখ্যালঘুদের জন্য আলাদাভাবে করতে হবে?

আমি (সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে) বলেছি, আপনারা দেশের নাগরিক। আপনাদের সমস্ত অধিকার সংবিধান দ্বারাই নিশ্চিত করা আছে। আমরা সকলেই চাই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক এবং সংবিধান আমাদেরকে যে সমস্ত অধিকার দিয়েছে সেগুলোও প্রতিষ্ঠিত হোক।”

এ বিষয়ে দ্য হিন্দুকে ড. ইউনূস বলেন, “আমাদের সংবিধান কমিশনে কে আছে এবং কে এর প্রধান (যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক শিক্ষাবিদ আলী রিয়াজ) আছেন সেটি আগে দেখুন এবং তারপর আপনি যা বলছেন তার সঙ্গে সমন্বয় করার চেষ্টা করুন…অন্যথায় এটি পুরোটাই প্রোপাগান্ডা।”

ড. ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের ১০০ দিন পূর্ণ হয়েছে। এখন পর্যন্ত দুই প্রতিবেশী দেশের সরকার প্রধানদের দেখা হয়নি। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “হ্যাঁ, এটি এখনও ঘটেনি। আমি যখন জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে গিয়েছি, তখন মোদি সেখান থেকে চলে গিয়েছিলেন।

আমি বাকুতে জলবায়ু সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলাম, কিন্তু মোদি সেখানে ছিলেন না, বিমসটেক (থাইল্যান্ডে) বাতিল করা হয়েছে এবং আমরা কেউই কমনওয়েলথ বৈঠকে যাইনি। তার মানে এই নয় যে— আমরা দেখা করব না।”

দুদেশের সম্পর্কে কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমরা শুধু প্রতিবেশী নই, ইতিহাস আমাদের একত্র করেছে। ভূগোল আমাদের একত্রিত করেছে। ভাষাগত সম্পর্ক আমাদের একত্রিত করেছে। সাংস্কৃতিক যোগসূত্র আমাদের একত্রিত করে। প্রথম দিন থেকেই আমি প্রধানমন্ত্রী মোদিকে সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করার প্রস্তাব দিয়েছি। অকার্যকর গোষ্ঠী হতে হবে কেন? এমনকি আমি পরামর্শ দিয়েছিলাম যে, সার্ক নেতারা নিউইয়র্কে মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য হলেও যেন বৈঠক করতে পারেন।”

এসময় বাংলাদেশ ও ভারত বিমসটেক, বিবিআইএন-এ সহযোগিতা করছে উল্লেখ করে ‘সার্ক কেন’ এমন প্রশ্ন করা হয় দ্য হিন্দুর পক্ষ থেকে। “সার্ক নয় কেন?”- পাল্টা প্রশ্ন করেন প্রধান উপদেষ্টা। বলেন, “আমরা যত বেশি বন্ধু এবং সম্পর্ক তৈরি করতে পারি, ততো ভালো। সার্ককে চলতেই হবে… এমন হওয়া উচিত নয় যে শুধুমাত্র দুই দেশের (ভারত ও পাকিস্তান) মধ্যে সম্পর্কের কারণে পুরো গোষ্ঠীটি অদৃশ্য হয়ে যায়। আমরা একটি রেজুলেশন পাস করতে পারি, ভারত-পাকিস্তানের যেকোনও ইস্যুকে এজেন্ডা থেকে স্থগিত করতে পারি, কিন্তু সার্ককে শেষ করতে পারি না।”

৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অভূতপূর্ব পরিবর্তন এনে দেয়। ওইদিন ১৬ বছরের শাসন ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই ঘটনা বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কীভাবে প্রভাবিত করতে পারে- এমন প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, “কেন এটা (ভারতের জন্য ধাক্কা) হবে? বাংলাদেশের বন্ধু দেশ হিসেবে ভারতেরও ওই দিনটি উদযাপন করা উচিত যে, বাংলাদেশ এমন একটি শাসন থেকে মুক্ত হয়েছে যেখানে মানুষ কষ্ট পেয়েছে, অনেককে হত্যা করা হয়েছে, অনেককে গুম করা হয়েছে এবং অনেক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়েছে।”

ভারতে শেখ হাসিনার অবস্থান দুদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অসুবিধা সৃষ্টি করছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, “হাসিনার ভারতে বসবাস করা, অন্তত আপাতত কোনো সমস্যা নয়।

তবে তিনি বাংলাদেশের বিষয়ে কথা বললে সমস্যা। তিনি বাংলাদেশিদের সঙ্গে কথা বলছেন এবং এটি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। তিনি তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন, এটাই সমস্যা।”

জেএন/পিআর

KSRM
পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জয়নিউজবিডি.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন news@joynewsbd.com ঠিকানায়।

এই বিভাগের আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ

×KSRM