চট্টগ্রাম নগরের কোতোয়ালী থানার আদালত প্রাঙ্গণে চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর মুক্তির দাবি ঘিরে সংঘর্ষে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় পৃথক তিনটি মামলা হয়েছে। বুধবার (২৭ নভেম্বর) নগরের কোতোয়ালী থানা পুলিশের করা এসব মামলায় ৭৬ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ১৪০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। তবে এখনো আইনজীবী হত্যার ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি।
পুলিশ বলছে, এখন পর্যন্ত ওই সংঘর্ষের ঘটনায় মোট ২৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যাদের মধ্যে ২০ জন পুলিশের ওপর হামলা করেছে এবং ৭ জন আইনজীবী আলিফ হত্যায় জড়িত।
এদিকে হত্যার শিকার আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফের জানাজা ও দাফন শেষে চট্টগ্রাম নগরে ফিরছেন তাঁর পরিবার এবং সহকর্মীরা। তবে হত্যার ঘটনায় বুধবারই তাঁরা মামলা করছেন না। মামলার বিষয়ে ওই আইনজীবীর পরিবার এবং সহকর্মীরা মিলে বুধবার রাতে সিদ্ধান্ত নেবেন।
পুলিশের তিন মামলায় আসামি ১৪৭৬
নগর পুলিশ জানিয়েছে, গতকাল (মঙ্গলবার) বিকেলে সনাতন জাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভরতদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এসময় পুলিশের ১২ জন সদস্যও আহত হন। এছাড়া ভাঙচুর করা হয় পুলিশের ব্যবহৃত একটি গাড়িও।
জানা গেছে, নগরের কোতোয়ালী থানার আদালত প্রাঙ্গণ, রঙ্গম সিনেমা হল এবং কোতোয়ালী মোড়— এই তিন এলাকাতে পুলিশের ওপর হামলা এবং গাড়ি ভাঙচুর হয়েছে। পৃথক তিন ঘটনায় পৃথকভাবে কোতোয়ালী থানা পুলিশ বাদী হয়ে তিনটি মামলা দায়ের করেছে।
এসব মামলায় আদালত প্রাঙ্গণে হামলার ঘটনায় ৪৯ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ৬শ থেকে ৭শ জন, রঙ্গম সিনেমা হলের সামনে সংঘর্ষের ঘটনায় ১৪ জনকে এজাহারনামীয় করে অজ্ঞাত ৩শ থেকে ৪শ জন এবং কোতোয়ালী মোড়ের ঘটনায় ১৩ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আড়াইশ থেকে ৩শ জনকে আসামি করা হয়েছে।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (জনসংযোগ) কাজী মো. তারেক আজিজ বুধবার (২৭ নভেম্বর) সন্ধ্যায় এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
আলিফের দাফন সম্পন্ন, মামলা করবে পরিবার
মঙ্গলবার সংঘর্ষের ঘটনায় হত্যার শিকার আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। আজ (বুধবার) বিকেল পাঁচটার দিকে চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি ইউনিয়নের ফারেঙ্গা গ্রামে দুটি জানাজা শেষে দাফন করা হয়।
গ্রামের বাড়ির জানাজায়ও মানুষের ঢল নামে। চট্টগ্রাম শহর ছাড়াও আশপাশের উপজেলা থেকেও নানা শ্রেণিপেশার মানুষ জানাজায় যোগ দেন।
আইনজীবী আলিফের সহকর্মী এবং চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির কার্যনির্বাহী সদস্য অ্যাডভোকেট শাহ ইমতিয়াজ রেজা চৌধুরী সন্ধ্যায় বলেন, ‘আমরা আমাদের সহকর্মীর দাফন শেষে চট্টগ্রামের পথে রওয়ানা হয়েছি। আমরা পৌঁছে তার পরিবার এবং জেলা আইনজীবীর সদস্যরা মিলে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব মামলা করার বিষয়ে। আজ মামলা করার সম্ভাবনা নেই। তবে এ ঘটনায় একাধিক মামলা হবে।’
চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আশরাফ হোসেন চৌধুরী রাজ্জাক মুঠোফোনে বলেন, ‘আলিফ হত্যার ঘটনায় মামলার সবকিছু চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছে। আমাদের সমিতির পক্ষ থেকে তাঁর পরিবারের সাথে বসে আলাপ করে বাদীকে হবে তা চূড়ান্ত করা হবে। তবে আজ মামলা হবে না।’
২৭ জন আটক, আলিফ হত্যায় ৭ জন সম্পৃক্ত
গতকাল সংঘর্ষের ঘটনায় ২৪ ঘণ্টায় মোট ২৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। পুলিশ বলছে, আটকদের মধ্যে ২০ জন পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় জড়িত এবং আইনজীবী আলিফ হত্যায় ভিডিও দেখে বাকি ৭ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে নগর পুলিশের উপকমিশনার (অপরাধ ও অপারেশন) রইছ উদ্দিন বলেন, ‘গতকাল আদালত প্রাঙ্গণে সংঘর্ষে একজন আইনজীবী নিহত হয়েছেন। এছাড়া পুলিশের ওপরও হামলা করা হয়। এসব ঘটনায় মোট ২৭ জনকে এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যাদের মধ্যে ২০ জন পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় জড়িত। বাকি ৭ জনকে আইনজীবী হত্যার ঘটনায় ভিডিও ফুটেজ দেখে শনাক্ত করা হয়।’
সেই ৬ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে বিস্ফোরক মামলা
অন্যদিকে, পাহাড়তলী থানার সরাইপাড়া এলাকা থেকে রাত পৌনে ১১টায় আওয়ামী লীগ-যুবলীগের ৬ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পুলিশের দাবি, ওই সময় তাদের কাছ থেকে ৪টি ককটেল উদ্ধার করা হয়। তারা বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের মুক্তির দাবিতে মিছিল করতে দলীয় নেতাকর্মীদের সংগঠিত করছিলেন।
পাহাড়তলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বাবুল আজাদ বলেন, ‘গতকাল চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের মুক্তির দাবিতে গ্রেপ্তার আসামিরা একটি মিছিল আয়োজন করে। আমরা খবর পেয়ে সাথে সাথে তাদের গ্রেপ্তার করি। তাদের কাছ থেকে ৪টি ককটেল উদ্ধার করা হয়েছে। মিছিলের আড়ালে আওয়ামী লীগের লোকজনদের সংগঠিত করছিলো তারা।’
তিনি আরও বলেন, ‘গ্রেপ্তার ৬ জনকে জিজ্ঞাসাবাদে আরও তিনজনের সম্পৃক্ততা মিলেছে। ওই তিনজনসহ মোট ৯ জনের নাম উল্লেখ করে বিস্ফোরক আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। ওই মামলায় তাদের বুধবার আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে।’
কোতোয়ালীতে সংঘর্ষের ঘটনায় তাদের সম্পৃক্ততা আছে কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে ওসি বলেন, ‘আমাদের যে মামলা নেওয়ার সেটি নিয়েছি। ওনারা (কোতোয়ালী পুলিশ) যদি সম্পৃক্ততা পায় তাহলে তারা তাদের মামলায় গ্রেপ্তার দেখাবে।’
গ্রেপ্তাররা হলেন—মিরসরাই উপজেলার ১৩ নম্বর মায়ানী ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি মো. আবু হেনা (৪২), সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মোমিনুল ইসলাম (৩৪), মায়ানী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য এবং আ.লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মো. ইয়াছিন উল্লাহ (৪৪), খৈয়াছড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. মামুনুর রশিদ (৪৮), সাংগঠনিক সম্পাদক শহীদ উদ্দিন খান (৪৮) এবং ফয়স লেক বেইজক্যাম্পের জিপলাইন অপারেটর যুবলীগকর্মী আব্দুর রহিম (৩২)।
রয়টার্সের প্রতিবেদন, সিএমপির প্রতিবাদ
এদিকে, আইনজীবী হত্যার ঘটনায় আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম রয়টার্সের প্রকাশিত প্রতিবেদন বস্তুনিষ্ঠ নয় জানিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)। এরপর রয়টার্সের ওই প্রতিবেদনে পুলিশের বক্তব্য সংশোধন করা হয়েছে।
বুধবার (২৭ নভেম্বর) নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) রইছ উদ্দিন স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ প্রতিবাদ জানানো হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, সনাতন জাগরণ মঞ্চের নেতা চন্দন কুমার ধর প্রকাশ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর গ্রেফতার ও জামিন শুনানিকে কেন্দ্র করে আদালত প্রাঙ্গণ ও তার আশেপাশের উদ্ভুত পরিস্থিতির উপর বিদেশি সংবাদমাধ্যম রয়টার্সে ২৭ নভেম্বর প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
আরও বলা হয়, এতে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের দক্ষিণ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার লিয়াকত আলী খানকে উদ্ধৃত করে একটি বক্তব্য প্রকাশ করা হয়। রয়টার্স বা কোনো সাংবাদিক এই বিষয়ে উপ-পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) লিয়াকত আলী খানের সাথে কথা বলেননি। ঘটনার সময়ে তিনি আদালত প্রাঙ্গণসহ আশপাশের এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার কাজে দায়িত্বরত ছিলেন।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, লিয়াকত নামে চট্টগ্রামে চার জন কন্সটবল আছে। তারাও কাউকে কোনো বক্তব্য দেননি। কারো বক্তব্য গ্রহণ না করেই নিজেদের মনগড়া বক্তব্যকে দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তার বক্তব্য বলে চালিয়ে দেওয়া সাংবাদিকতার নীতিমালা পরিপন্থী। ভবিষ্যতে রয়টার্স ও সহ সকল গণমাধ্যম এই ধরনের সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে।
হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততার অভিযোগে বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষার্থী বহিষ্কার
আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততার অভিযোগে এক শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিস্কার করেছে বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ। ওই শিক্ষার্থীর নাম শুভ কান্তি দাশ। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।
বুধবার (২৭ নভেম্বর) বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক সভায় এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার ড. এস এম সোয়েব স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে এই তথ্য জানানো হয়। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততার অভিযোগ তুলে তাঁর ছাত্রত্ব বাতিলের দাবি জানায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে।
বিষয়টি সিভয়েস২৪’কে নিশ্চিত করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার সালাউদ্দিন শাহরিয়ার।
জেএন/এমআর