গণতন্ত্রের ধ্বজা উড়িয়ে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতার মসনদে আরোহন করা যায়, আবারো প্রমাণিত হলো। পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ একটি গৌরবজ্জ্বল উদাহারণ হয়ে থাকল। বাংলাদেশের অধুনা প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া দুর্নীতির দায়ে এখন কারাগারে। গভীর সঙ্কটে পড়া বিএনপি ঐক্যফ্রন্ট গড়ে ‘সুদিনে ফেরা’র স্বপ্ন দেখলেও নির্বাচনে হেরে দলটির কর্মীদের এখন দিশা হারানোর দশা। মানুষের মুখে মুখে এখন উন্নয়নের দল আওয়ামী লীগের ব্যাকথ্রু দিয়ে ফিরে আসার গল্প। জনমানুষের আস্থা বহাল থাকার এতবড় প্রমাণ আর কী হতে পারে?
যে বছর ভোট হলো, সেই বছর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পদার্পণ করছে ৭০ বছরে (২৩ জুন)। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এ দলটি প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে লড়ে এসেছে। বাংলাদেশে যখন সামরিক শাসন জারি ছিল, তখনও তারাই ছিল রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রধান শক্তি। সেই তুলনায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু একটি দল। বিপুল ভোটে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় ফিরে আসার পর সরকারের প্রতি কিছু পরামর্শ নিবেদন করছি। যদিও তৃণমূলের লাখো কোটি শুভনুধ্যায়ী ও সমর্থকের দল আওয়ামী লীগ দলটি কিংবা বিশ্ব নেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি পরামর্শ দেয়ার মতো ক্ষমতা কি আমার আছে, সেটা ভেবেও সংকোচ বোধ করছি। কিন্তু একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে দু’টি কথা না বললেই নয়।
আমার আশা, ব্যাংকিং খাতের যে অব্যবস্থাপনার অভিযোগ উঠেছে, সেটা সংস্কারের দ্রুত মনোনিবেশ করতে হবে। সভা-সেমিনারের ভালো বক্তা বা অর্থনীতির পণ্ডিতের চাইতেও একজন ‘দক্ষ ম্যানেজার’ এই মুহূর্তে ব্যাংকিং খাতকে চাঙা করতে বিশেষ দরকার। বর্তমান সময়ে সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ লাখ লাখ শিক্ষিত বেকার তরুণ-তরুণীর জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। যা আওয়ামী লীগের ইশতেহারে অগ্রাধিকার পেয়েছে। পাস করা বেকার ও শিক্ষার্থীরা যাতে নানা অর্থনৈতিক সেক্টরে ইন্টার্ন-শিক্ষানবিশ হিসাবে কাজ শেখার সুযোগ পায় সেই ব্যবস্থা করতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারে অদক্ষ জনশক্তি রপ্তানি সুযোগ ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে, কিন্তু জাপানসহ পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশেই বয়স্ক লোকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় আওয়ামী লীগ এখন নতুন বৈদেশিক বাণিজ্যে সেদিকে মনোযোগ দিতে পারে। সরকারি আর প্রাইভেট সেক্টরগুলো একসঙ্গে হাতে হাত ধরে এগোলে দেশের সব নাগরিকের জন্য উইন-উইন সিচুয়েশন তৈরি সম্ভব হবে। এই বিষয়গুলো বিশেষভাবে নজর দিতে হবে সরকারকে।
আমরা দেখেছি, সরকার যেভাবে চমৎকারভাবে মসজিদের ইমাম থেকে শুরু করে সামরিক ব্যবস্থাপনা, সরকারি সেক্টরে চাকরিজীবী ও গণমাধ্যম সেক্টরের সাংবাদিকদের জন্য মানবিক কল্যাণের উদ্যোগ নিয়েছে; সেই দৃশ্য দেখতে চাই এখন প্রাইভেট সেক্টরেও। এখনই সময় বেসরকারি চাকরিজীবীদের নানা দাবি-দাওয়া পূরণে মনোনিবেশ করার। আওয়ামী লীগ যেভাবে বিপুল ভোটে ক্ষমতায় এসেছে, তাতে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য দুটোই বেড়ে গেল। বিএনপি থেকে শিক্ষা নেওয়ারও সময় এখন সরকারের। কারণ খালেদা জিয়ার জীবনে এখন দুর্ভাগ্য। তার দলে সুবিধাবাদী আর সুযোগ সন্ধানীদের ভিড়। বিএনপি যতটা না গণতান্ত্রিক দল, তার চাইতে বেশি মূলত একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম। তারা এন্টি-আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল। একটি সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল হওয়ার পথে পা বাড়ালেও তারা ব্যর্থ হয়েছে। বিএনপি আন্দোলন দূরে থাক মাঠেই নামতে পারে না। তাদের এই দীনতা কোনোদিনই দূর হবে না লন্ডন থেকে ভেসে আসা গায়েবি আওয়াজে!
বাংলাদেশের রাজনীতি কখনোই কারো দম্ভ মানেনি। এই মাটির রক্ত ভেজা আছে। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় শহিদি-গোরস্থানের দেশ বাংলাদেশ। এই দেশের মাটিতে শুয়ে আছে লাখো মৃত্যুঞ্জয়ী বীর শহিদ। এই দেশের নদীতে মায়ের মুখ, ফুলে শহিদের ভালোবাসা। এই দেশকে ভালো না বেসে, ষড়যন্ত্রের বীজ বপন করে গোপনে প্রতিশোধের নেশায় কোনো রাজনীতি টিকতে পারে না। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদিনের রক্তমাখা শোকের দিনে কেক কাটার উল্লাস, যুদ্ধাপরাধীদের সওয়ার করা, দশ ট্রাক অস্ত্র পাচারসহ রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে জঙ্গিঘাঁটিতে পরিণত করার মতো প্রতারণা দেশের মানুষ মেনে নেয় না। ইতিহাসকে পায়ে ঠেলার দায় নিয়ে সেই বিএনপি আজ অসহায়। এই নিঃসঙ্গ বিএনপি থেকে শিক্ষা নিতে হবে সরকারি দলকেও। পৌষের ভোট বিপ্লব যেন আমাদের ভাবতে শেখায়, এক মাঘে শীত যায় না।
বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একাগ্রতা, নিষ্ঠা ও দূরদর্শিতায় পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাঙালিদের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। সেই বঙ্গবন্ধুর পাশে আজকের জাতীয় নেতারা বড়ই ক্ষীণকায়। বঙ্গবন্ধু দেশ-জাতির জন্য জীবনভর রাজনৈতিক ঝুঁকি নিয়েছিলেন। নিয়েছিলেন জীবনের ঝুঁকি। আজ বিএনপির কোন নেতার মধ্যে সেই ঝুঁকি দেখি না। এখানেই বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের পার্থক্য।
নির্বাচনে এই অভূতপূর্ব জাগরণের কারণ কী? কারণ, মানুষ পেট্টোল বোমার আগুন সন্ত্রাসকে ভুলে যায়নি। মানুষ টানা দশবছর অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে মনে রেখেছে। মানুষ দেখেছে চোখের সামনে ১০০টি ইকনোমিক জোন গড়ে ওঠতে। মানুষ দেখেছে বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ। পদ্মা সেতু থেকে শুরু করে কর্ণফুলী টানেল এখন বাস্তবায়নের পথে। এসব কিছু সরকারের ভূমিধস বিজয়ের নেপথ্য হিসেবে কাজ করেছে। তাই দেশের বিশিষ্টজন থেকে শুরু করে ভুখা মানুষ কিংবা আন্তর্জাতিক মহল পর্যন্ত এই সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ভুয়সী প্রশংসা করেছে। ভোটের ফল প্রকাশের সাথে সাথে জাতিসংঘ, ওআইসি থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক মহল সবাই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানিয়েছে।
অপরদিকে বিএনপির ভোট বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে মানুষ বুঝেছে প্রায় দশ বছরের জনবিচ্ছিন্নতা, ২০১৪ সালের নির্বাচন প্রতিহত করার নামে মানুষ পোড়ানো ও সম্পত্তি নষ্ট করা, অবরোধ নাটকের মাধ্যমে ব্যবসার ক্ষতি, স্বাধীনতাবিরোধী দেশদ্রোহী অপশক্তির সাথে গাঁটছড়া বাঁধা, পাকিস্তান তথা আইএসআই-এর সঙ্গে প্রকাশ্য দহরম-মহরম কিন্তু অপ্রকাশ্যে ভারতের সাথে খাতির জমানোর বৃথা চেষ্টা, তারেক জিয়ার মতো অপরিনামদর্শী নেতার পরামর্শে পরিবারতান্ত্রিক সঙ্কট জিইয়ে রাখা ইত্যাদি। বিএনপির অনেক ত্যাগী নেতার অভিযোগ এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত মৃদু গোমর এই যে, লন্ডনে বসে ভোটের প্রাথীদের বাছাইয়ের নামে যে নমিনেশন বাণিজ্য হয়েছে, তার ফলে বিএনপির সত্যিকারের ত্যাগী নেতৃত্ব ভোটের লড়াইয়ে আসতে পারেনি। বিএনপি’র ছিটকে পরার অন্যতম কারণ এটিও। প্রতিপক্ষের এসব ফাউল ও পেনাল্টির বিরুদ্ধে মধুর প্রতিশোধ নিয়েছেন শেখ হাসিনা। কিভাবে সম্ভব হলো এই মধুর প্রতিশোধ? প্রতিশোধটি তিনি নিলেন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। তিনি একদিকে চরম সমালোচনা সত্ত্বেও রক্ষণশীল ইসলামি দলের সাথে কৌশলে ঐক্য করে তাদের নির্বিষ করলেন। সামলে রাখলেন। জাতীয় পার্টিকে সাথে রেখে ঐক্য করলেন, বিএনপিকে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন ও কোণঠাসা করলেন। ভোটের পরদিন দেখা গেল, বিএনপির ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেল। গ্রেনেড ছুড়তে হলো না, গুলি করতে হলো না, বিএনপি নিজেই আউট হয়ে গেল।
ভিন্নদিকে আওয়ামী লীগ কী করলো? সুশৃঙ্খল নেতৃত্ব, সময় উপযোগী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক অগ্রগতিকে অবলম্বন করে দু’বছর ধরে সঠিকপথে নির্বাচনী প্রস্তুতি গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ বিরাট জয় পেয়েছে। সেদিন আর বেশি দূরে নেই- ইন্দিরা গান্ধী, চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা, মার্গারেট থ্যাচার, ভিগদিস ভিনগোদি ও মেরি মেকলিসকে টপকিয়ে পৃথিবীর দীর্ঘতম সময়ের সফল সরকারপ্রধান হিসেবে বিরাজমান হবেন শেখ হাসিনা।
যদিও সরকারবিরোধী পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে, উন্নয়ন দৃশ্যমান, কিন্তু দেশে গণতন্ত্র বিলীয়মান। সত্য হলেও এটাই এখন সময়ের বাস্তবতা। বাঙালি নিশ্চয় ভুলে যায়নি, নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরি আইন জারির সময় সশস্ত্র বাহিনীর কাছে একটানা দশ বছর ক্ষমতা চেয়েছিলেন! আমরা কি ভুলে যাবো মাহথির মোহাম্মদের মালয়েশিয়ার কথা? মাহাথির মোহাম্মদ আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি। তিনি ১৯৮১ সালে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন দল পরপর পাঁচবার সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। তিনি এশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। মালয়েশিয়া শিক্ষা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে যে সাফল্য পেয়েছে, সেই পথই তো হওয়ার কথা পাথেয়। মানুষের ভাগ্য উন্নয়ন করলে, রাজপথের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব। দেশ এখন উন্নত বিশ্বের সারিতে যাত্রা করেছে, আমরা এই সরকারের প্রতি আস্থা রাখতে চাই। সদ্য স্বাধীন দেশে আমরা বঙ্গবন্ধুকে মূল্যায়ন করতে পারিনি। একাত্তরের স্বাধীন দেশে আমরা জাতির পিতাকে তিন বছরের বেশি সময় দিতে পারিনি। এতটাই ধৈর্যহারা ছিলাম আমরা। কিন্তু ২০০৮ সালে পরিস্থিতি বদলে গেল। আমরা ধৈর্য ধরলাম। উন্নয়নের গলি থেকে সড়ক হয়ে মহাসড়কে হাঁটলাম দশ বছর। আমরা বিফলে যাইনি, যাব না।
উন্নয়নের স্লোগানকে বুকে ধারণ করে যে আওয়ামী লীগ বিপুল জনসমর্থন নিয়ে এসেছে তাদের জন্য একটি পরামর্শ রইলো। যদিও করিৎকর্মা ক্যারিশমাটিক নেত্রী শেখ হাসিনা ও ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে পরামর্শ দেয়ার ধৃষ্টতা আমার নেই। কিন্তু সময় থাকতে থাকতে এই কথাগুলো না বললেই নয়। সেটা হলো- এই বিপুল ম্যান্ডেট যেন অতিআত্মবিশ্বাসী না করে তোলে আওয়ামী লীগকে। স্বেচ্ছাচারিতা আর অতিউৎসাহী হাইব্রিড নেতৃত্ব যেন আওয়ামী লীগের দুর্গ থেকে বহুদূরে থাকে, সেটাই এখন চেক দেয়ার সময়। আজকের নিঃসঙ্গ বিএনপি থেকে শিক্ষা নিতে হবে সরকারি দলকেও। পৌষের ভোট বিপ্লব যেন আমাদের ভাবতে শেখায়, এক মাঘে শীত যায় না।
অহীদ সিরাজ চৌধুরী (স্বপন)
সম্পাদক, জয়নিউজবিডি