সাংবাদিক কন্যা রাফিদা খান রাইফার মৃত্যুর ঘটনায় হাইকোর্টের নির্দেশে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ। চার সদস্যের এই কমিটির আহ্বায়ক হলেন স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের যুগ্ম সচিব সাইফুল্লাহিল আজম। এছাড়াও এই কমিটিতে বিএমডিসির একজন প্রতিনিধি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন প্রতিনিধি এবং চট্টগ্রামের সিভিল সার্জনকে সদস্য সচিব করা হয়েছে।
চার সদস্যের এই তদন্ত কমিটিকে দ্রুত তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দিতে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৮ জানুয়ারি তদন্ত করতে চট্টগ্রাম আসছেন ওই তদন্ত কমিটির সদস্যরা। তারা চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে ওই দিন সকাল ১০টায় তদন্তের কাজ শুরু করবেন। উল্লিখিত সময়ে তদন্ত কমিটির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে শিশু কন্যা রাইফার বাবা সাংবাদিক রুবেল খান, ম্যাক্স হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. লিয়াকত আলী খান, ডা. বিধান রায় চৌধুরী, ডা. দেবাশীষ সেনগুপ্ত এবং ডা. শুভ্র দেবকে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে।
রাইফার বাবা সাংবাদিক রুবেল খান জয়নিউজকে বলেন, ‘সামান্য গলা ব্যথা নিয়ে গত বছরের ২৮ জুন নগরের ম্যাক্স হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল শিশু রাইফাকে। কিন্তু ওই হাসপাতালে ভর্তির পর থেকেই রাইফাকে ভুল চিকিৎসা দেওয়া হয় এবং চিকিৎসায় সীমাহীন অবহেলা করা হয়। আমি বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও চিকিৎসকরা আমার শিশু কন্যাকে রফিসিন নামের একটি অ্যান্টিবায়োটিক পুশ করেন। আমার আপত্তির মুখে চিকিৎসকরা বলেন, এই অ্যান্টিবায়োটিক পুশ করা হলে আপনার মেয়ের কোনো ক্ষতি হবে না বরং ওর গলা ব্যথা দ্রুত ভালো হয়ে যাবে। অথচ ওই অ্যান্টিবায়োটিক পুশ করার পর আমার মেয়ের শরীরের অবস্থা দ্রুত খারাপের দিকে যেতে থাকে। পরে বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পারি, ওভারডোজ অ্যান্টিবায়োটিক পুশ করায় আমার মেয়ের রিঅ্যাকশন হয়েছিল। ওই রিঅ্যাকশনের কারণে তার শ্বাস কষ্ট ও খিঁচুনি হয়। খিঁচুনির কারণে আমার মেয়ের যখন মুর্মূর্ষু অবস্থা, তখন আবারও ভুল চিকিৎসার শিকার হয় সে। তাকে এনআইসিইউতে না নিয়ে কেবিনের ভেতর ওভারডোজ সেডিল পুশ করা হয়। এভাবে বারবার অবহেলা ও ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে গত বছরের ২৯ জুন রাতে ম্যাক্স হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অকালে মৃত্যুবরণ করে আমার একমাত্র শিশুকন্যা রাইফা।’
এই মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের যে কমিটি গঠন করা হয়েছিল, সেই কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে শিশু রাইফার চিকিৎসায় অবহেলার বিষয়টি উঠে এসেছে। এছাড়াও স্বাস্থ্য অধিদফতরের তদন্ত কমিটি ওই ম্যাক্স হাসপাতালের ১১টি ত্রুটি চিহ্নিত করেছে।
এরপর ম্যাক্স হাসপাতালে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে র্যাবের ম্যাজিস্ট্রেট ওই হাসপাতালের বিভিন্ন অনিয়মের কারণে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করেন।
প্রসঙ্গত, ম্যাক্স হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত বছরের ২৯ জুন রাতে মাত্র দুই বছর চার মাস বয়সেই মৃত্যুবরণ করে সাংবাদিক কন্যা রাইফা। অবহেলা ও ভুল চিকিৎসায় ফুটফুটে এই শিশু কন্যার অকাল মৃত্যুতে সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। একমাত্র শিশু কন্যার এমন মৃত্যুর ঘটনায় চট্টগ্রাম নগরের চকবাজার থানায় গত ১৮ জুলাই একটি এজাহার দায়ের করেন রাইফার বাবা সাংবাদিক রুবেল খান। দু’দিন পর সেটি মামলা হিসেবে গ্রহণ করে চকবাজার থানা পুলিশ। এই মামলায় ডা. বিধান রায় চৌধুরী, ডা. দেবাশীষ সেনগুপ্ত, ডা. শুভ্র দেব ও বেসরকারি ম্যাক্স হাসাপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. লিয়াকত আলী খানকে আসামি করা হয়। এই মামলায় পুলিশি তদন্ত চলছে।
এদিকে, দেশের হাসপাতালগুলোতে বারবার চিকিৎসায় অবহেলা ও ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুর ঘটনা প্রতিরোধ এবং দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এবং চিকিৎসক ও চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জনের স্বার্থে রাইফার মৃত্যুর ঘটনায় হাইকোর্টেও একটি রিট পিটিশন দায়ের করেন রাইফার বাবা রুবেল খান।
গত বছরের ১৪ আগস্ট করা ওই পিটিশনের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ সাতজনের ওপর রুলনিশিসহ কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করেন হাইকোর্ট। সেইসঙ্গে ভুল চিকিৎসার জন্য শিশুর মৃত্যুর প্রেক্ষিতে ক্ষতিপূরণসহ শিশুটির মৃত্যুর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। ওই নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে দ্রুত তদন্ত শেষে প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে।
ওই তদন্ত কমিটি ৮ জানুয়ারি তদন্ত করতে চট্টগ্রাম আসছে।