নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। বিশেষ করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একতরফা ভোট, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর রাতের ভোট এবং ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি ডামি সংসদ নির্বাচন নিয়ে আছে দেশ-বিদেশে চরম বিতর্ক।
এ পরিস্থিতিতে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে দেশত্যাগে বাধ্য হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পরিবর্তিত এ বাংলাদেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন এ এম এম নাসির উদ্দীন। যার অধীনে আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
সিইসি হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে তিনি ভোটারদের ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তার দাবি, ফ্রি ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল ইলেকশন করার জন্য যা যা করা দারকার, তিনি তা করবেন।
ন্যূনতম প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে যে কোনো সময় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তার নেতৃত্বাধীন কমিশন প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। একই সঙ্গে অনানুষ্ঠিকভাবে নির্বাচনি রোডম্যাপের কার্যক্রম শুরু করেছে কমিশন।
সিইসির মতে, জাতীয় নির্বাচনের জন্য আমাদের প্রস্তুতি চলছে পুরোদমে। সময় ক্ষেপণ করছি না, করব।
তবে নির্বাচন কবে হবে—তা প্রেডিক্ট করা মুশকিল। জনগণ বিগত সময়ে ভোট দিতে পারেনি। আমরা জনগণের ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করতে চাই।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনের নিজ কক্ষে সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দীন ইত্তেফাকের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে নির্বাচন-সংক্রান্ত নানা বিষয়ে কথা বলেছেন। নিচে প্রশ্ন-উত্তর আকারে সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো—
প্রশ্ন: জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে দেশ স্বৈরাচারমুক্ত হলো। এমন পরিস্থিতিতে আপনি দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। ভোটাধিকারবঞ্চিত জনগণকে নিয়ে আপনার ভাবনা কী?
সিইসি: শেষ বয়সে আল্লাহ-তায়ালা একটা বিরাট সুযোগ আমাকে দিয়েছেন। আমি এটাকে দেশের সেবা করার একটা সুযোগ হিসেবে নিয়েছি। জনগণকে ভোটকেন্দ্রমুখী করতে যা যা করার, সবই করব।
ইতিমধ্যে ভোটার কার্যক্রম শুরুর মাধ্যমে নির্বাচনি আমেজ তৈরির চেষ্টা করছি। আশা করছি জনগণ নিরাপদে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবে।
প্রশ্ন: প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে একটি সংবাদ সম্মেলন করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, সরকারের সঙ্গে আলাপ করে রোডম্যাপটি ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন। কবে নাগাদ রোডম্যাপটি ঘোষণা করা হতে পারে? সরকারের তরফ থেকে কোনো ইনসট্রাকশন পেয়েছেন কি না?
সিইসি: দেখেন, আমরা তো সরকারের ইনসট্রাকশনের ওপর চলি না। আমরা সংবিধান অনুযায়ী চলি। সরকার কিছু সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। নির্বাচন করতে গেলে নির্বাচন কমিশনেরও কিছু সংস্কারের দরকার হবে।
এসেনশিয়াল রিফরম, যেগুলো নির্বাচন করার জন্য জরুরি, ঐ ম্যানডেটরি সংস্কার না করে তো নির্বাচনে যেতে পারব না। সেগুলো করে আমরা নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হব।
তবে, ইলেকশনের জন্য আমাদের প্রস্তুতি চলছে পুরোদমে। অনানুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনি রোডম্যাপের কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
প্রশ্ন :নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের আগে কিছু কাজ করে। ভোটার তালিকা হালনাগাদ, সিমানা পুনরায় নির্ধারণ, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, নতুন পর্যবেক্ষকদের নিবন্ধন। এগুলো করতে তো সময় লাগবে। সেক্ষেত্রে আপনার ভাবনা কী?
সিইসি : আইন অনুযায়ী খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ হবে ২ জানুযারি। চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ হবে দুই মার্চ। আমাদের তথ্যভান্ডারে যা আছে, তা দিয়ে চূড়ান্ত তালিকা হয়ে গেল। আমরা চাচ্ছিলাম যে, অনেক রোহিঙ্গা ভোটার হয়ে গেছে। অনেক ফেইক ভোটার হয়ে গেছে। তারপর আন্দোলনে যারা এত রক্ত দিল, সেই ইয়াংগার জেনারেশনকে ভোটার করতে হবে। বাদ পড়াগুলো আমরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ইনপুট করছি।
হালনাগাদ কিন্তু মার্চে শুরু হবে এমনটা না, হালনাগাদ শুরু হয়ে গেছে। আর ফেইক ভোটারগুলো আমরা আইডেন্ডিফাই করছি। নীলফামারী সদর উপজেলা থেকেই ভোটার হয়েছে ১৯ জন রোহিঙ্গা।
গত তিনটা নির্বাচন এ দেশের মানুষ দেখেছে তো। দেখে তারা নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনব্যবস্থার ওপর আস্থা হারিয়েছে। শুধু যদি অফিসে বসে ভোটার তালিকা করি, দেখবেন অনেক নারী ভোটার বাদ পড়ে যাবে। সেজন্য, আমরা চাই, মানুষের ভেতর একটা উত্সাহ তৈরি হোক।
প্রশ্ন : বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমান এবং জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বারবার বলছেন, বাংলাদেশ নিয়ে অনেক চক্রান্ত হচ্ছে।
নির্বাচন নিয়ে যদি সময়ক্ষেপণ করা হয়, সেক্ষত্রে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে না। পলিটিক্যাল পার্টির গ্রাম-গঞ্জে যে পাওয়ার আছে, সেটা কিন্তু এ সরকারের তা নেই। ২৫ সালের মধ্যে নির্বাচন সম্ভব কিনা?
সিইসি : আমরা সময়ক্ষেপণ করছি না। করব না। আমরা নির্বাচন করার জন্য পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে রাখব। এবং সেটা চলছে। জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে কমিশনের কোনো ঘাটতি নেই। একটি জাতীয় নির্বাচনের জন্য যা যা করার তার কার্যক্রম আমরা শুরু করেছি।
প্রশ্ন : এর আগে আওয়ামী লীগকে বিশেষ সুবিধা দিতে ১৩০টি সংসদীয় আসনের সীমানা বদল করা হয়েছে। এটি নিয়ে আপনাদের পরিকল্পনা কি ?
সিইসি : আসন বিন্যাসের কাজ আমরা শুরু করেছি। একজন নির্বাচন কমিশনারের নেতৃত্বে একটি কমিটিও করে দেওয়া হয়েছে। একটি ভালো নির্বাচন করার জন্য যে যে প্রস্তুতি দরকার সব কাজ চলছে।
প্রশ্ন : নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন প্রসঙ্গে আপনার মতামত জানতে চাই?
সিইসি : আমাদের নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট যখন পেয়ে যাব, তখন দেখা যাবে। কেউ কেউ নাকি দাবি করেছে, কোনো নিবন্ধন লাগবে না। সংস্কার কমিশন থেকে যদি এমন সুপারিশ আসে, কোনো নিবন্ধনই লাগবে না এবং নির্বাচন কমিশন যদি তা গ্রহণ করে; তাহলে তো এ প্রসঙ্গই থাকল না।
প্রশ্ন : আপনারা কীভাবে বুঝবেন, শিডিউল দেওয়ার এখন উপযুক্ত সময়। যেহেতু এখন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা নেই। আগে যেমন সংসদ ভাঙলে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার বিধান ছিল। এখন সেসব নেই। তাহলে আপনি কীভাবে বুঝবেন, আমার এখন নির্বাচনটা করতে হবে বা আগামী তিন মাসের মধ্যে নির্বাচনটা করতে হবে?
সিইসি : আমাদের সঙ্গে কমবেশি বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা হয়। কিন্তু, আমরা ইলেকশন করার জন্য মোটামুটিভাবে প্রস্তুত থাকব। এটা হলো কথা। উনারা যখনই করতে চান, আমরা প্রস্তুত থাকব।
প্রশ্ন : সরকার বা রাজনৈতিক দলগুলো বললে, সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন কমিশন আগামী তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন করতে পারবে কিনা?
সিইসি : তিন মাস বললে তো হবে না। প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো করতে হবে না? নির্বাচন করতে গেলে কেবল নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার করলে তো হবে না। সাংবিধানিক সংস্কার আছে। রাষ্ট্রপতির নির্বাচন সরাসরি হবে নাকি অন্যভাবে হবে। সব মিলিয়ে কিছু প্রয়োজনীয় সংস্কার তো করতে হবে।
প্রশ্ন : যেসব সংস্কার পলিটিক্যাল পার্টি ছাড়া হবে না, সেগুলোর ব্যাপারে আপনার মন্তব্য জানতে চাই।
সিইসি : এগুলো আমার মাথাব্যথার বিষয় না। যারা রিফর্ম কমিশনগুলো গঠন করেছে, তারা বলেছে যে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে তারা ফয়সাল্লা করবে। যেগুলো সম্মিলিতভাবে গ্রহণযোগ্য হবে, সেগুলো আপনারা (ইসি) অ্যাকসেপ্ট করবেন।
এ ধরনের আলোচনা পত্রপত্রিকার মাধ্যমে আমরা জেনেছি। রিফর্ম কমিশনের রিপোর্টগুলো আগে আমরা দেখি। সংস্কার কমিশনের রিপোর্টগুলো পাওয়ার পর আমরা স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কথা বলব।
প্রশ্ন : গত তিনটা সংসদ নির্বাচন অনেক বিতর্কিত। এ নির্বাচনে যারা জড়িত ছিল, তারা এখন মাঠ প্রশাসনে রয়েছে। তাদের শাস্তির আওতায় আনার কোনো পরিকল্পনা রয়েছে কি না।
সিইসি : আমাদের সঙ্গে আলোচনায় নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার এসব কথা উঠিয়েছেন। সুপারিশে কী আসে, তা পাওয়ার আগে বলা যাচ্ছে না কিছু্।
প্রশ্ন : প্রতি সংসদ নির্বাচনের আগে পলিটিক্যাল পার্টির সঙ্গে একটি সংলাপের আয়োজন করে নির্বাচন কমিশন। এবার আপনারা সংলাপ করবেন কি না?
সিইসি : আমরা প্রয়োজনে অবশ্যই সংলাপ করব। কারণ, উনারাই তো আমাদের মেইন প্লেয়ার। আমরা মাঠটা তৈরি করে দেব। রুলস অব দ্য গেম মেনে তারা খেলবেন। উনাদের বাদ দিয়ে তো কোনোকিছু চিন্তায় করা যায় না। উনাদের সঙ্গে আলোচনা করতেই হবে।
প্রশ্ন : আপনি যেহেতু একজন আমলা ছিলেন। এই প্রশাসনের ভেতরেও তো একটা গুণগত পরিবর্তন দরকার আছে। যেমন রিটার্নিং অফিসার বরাবরই ডিসিরা হয়। ইলেকশন কমিশনের কর্মকর্তা হলে, তার কাজের ধারণা এক ধরনের। ডিসিরা হলে তাদের কাজের ধারণা আরেক ধরনের। ডিসিরা সব সময় একটা চেইনের মধ্যে চলে।
ইলেকশন কমিশনের কর্মকর্তারা হলে স্বচ্ছতা একটু বেশি থাকে। সেক্ষেত্রে নিজেদের কর্মকর্তাদের দিয়ে আপনাদের ইলেকশন করার কোনো প্ল্যান রয়েছে কিনা।
সিইসি : নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো আগে আসুক, তার আগে আমি কিছুই বলতে পারব না। এই যে আপনি যেগুলো বলছেন, তারাও এগুলো আলোচনায় রাখছে। সুপারিশটা আগে আসুক। আমি কাউকে সাপোর্ট করার জন্য, প্রমোট করার জন্য আসিনি। একটা ফ্রি, ফেয়ার এবং ক্রেডিবল ইলেকশন করার জন্য যা যা করা দরকার, তা তা করব ইনশাল্লাহ।
জনগণ বিগত সময়ে ভোট দিতে পারেনি। আমরা জণগণের ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করতে চাই। মানুষকে নির্বাচনমুখী করা, এটা বিগ চ্যালেঞ্জ। এই যে ঘরে ঘরে যাওয়া (ভোটার তালিকা হালনাগাদের জন্য), কেন যাওয়া? আমরা ঘরে ঘরে গেলে ওরা বুঝবে যে, ভোটের একটা আমেজ শুরু হয়েছে।
প্রশ্ন : ভোটের সঙ্গে যুক্ত থাকা ব্যক্তিরা ভোট দিতে পারেন না। তাদের ব্যাপারে কোনো চিন্তা রয়েছে কিনা?
সিইসি : যারা ভোটের সঙ্গে রিলেটেড থাকবে, তাদের একটা ভোটের ব্যবস্থা কীভাবে করা যেতে পারে, তা নিয়ে আমরা কাজ করছি। শুধু তাই নয়, আমরা প্রবাসীদের ভোটার হিসেবে ইনক্লুড করার জন্য আমাদের পক্ষে যা যা করা সম্ভব, আমরা করছি।
প্রশ্ন : ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে নাগাদ হতে পারে, আপনার ধারণা জানতে চাই।
সিইসি : আমরা ধারণা করতে চাই না। প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো করতে করতে কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। এ মুহূর্তে প্রেডিক্ট করা মুশকিল।