চলছে বোরো ধানের ভরা মৌসুম। বিদেশ থেকেও চাল আমদানি উন্মুক্ত রয়েছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথেও স্বাভাবিক রয়েছে বাণিজ্য। ইতিমধ্যে ভারত থেকে বেসরকারি পর্যায়ে পর্যাপ্ত পরিমান চাল দেশে এসেছে। আরো আসছে। সব মিলিয়ে বলা যায় চালের দৃশত কোনো সংকট নেই।
কিন্তু ধানের এমন ভরা মৌসুমেও অস্থির হয়ে উঠেছে চট্টগ্রামের চালের বাজার। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, দেশের অস্থিতিশীলতার সুযোগে এক শ্রেণীর অসাধু মিলার ‘দাম আরো বাড়বে’ এমন গুজব ছড়িয়ে দাম বাড়াচ্ছে।
আসলে চালের বাজার এখনো খুচরা বিক্রেতা থেকে, মিলার, ফরিয়া, কৃষক পর্যন্ত সেই পুরানো সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি। এ চক্রের ‘চালবাজিতে’ লাগামহীন চালের বাজার। ফলে বেড়েছে ধান-চালের মজুদপ্রবণতা। অল্প সরবরাহ রেখে, দাম বাড়িয়ে ফায়দা লুটছে সংশ্লিষ্টরা।
অথচ সরকার এ বিষয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করলেই চালের দাম নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন সাধারণ মানুষ।
জানা গেছে, সাধারণত বাংলাদেশে কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে (অক্টোবর-নভেম্বর) শুরু হয় বোরো ধান রোপণ। আর সেই ধান কাটা হয় বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ (এপ্রিল-জুন) মাসজুড়ে। সে হিসেবে এখন বোরো মৌসুমের সোনালী সময়। হিসেব মতে দেশজুড়ে চালের সংকট না থাকারই কথা।
চট্টগ্রামের চালের বাজার ঘুরে দেখা যায়, বোরো ধানের নতুন চাল বাজারে এলেও গেল কয়েক সপ্তাহ ধরেই প্রতি কেজি চালের দাম ৩ থেকে ৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
কোরবানীর ঈদের আগে দাম তুলনামূলক কম থাকলেও ঈদ পরবর্তী গেল এক মাসের ব্যবধানে পাইকারিতে চাল ভেদে বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) সর্বোচ্চ ২৫০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে।
দীর্ঘদিন স্থিতিশীল থাকার পর বোরোর ভরা মৌসুমে দাম বাড়ার কারণে হিসেবে পাইকারদের মজুদকরণকেই দায়ী করছেন অনেকেই।
খুচরা ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, পাইকারির কাছ থেকে বেশি দামে কেনার কারণে খুচরা বাজারে বেশি দামে চাল বিক্রি করতে হচ্ছে।
এদিকে এমন অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে দাবি করছেন চট্টগ্রামের পাইকারি ব্যবসায়ীরা। তাদের মতে, দেশী চালের প্রধান উৎস উত্তরবঙ্গের মিল মালিক এবং সেখানকার ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট, পরিবহনের ভাড়া বেড়ে যাওয়া ও কৃষকদের ধানের দাম বাড়ানোর কারণে চালের দাম ব্যাপক হারে বাড়ছে।
রবিবার বিকেলে চট্টগ্রামের চালের দুটি বড় পাইকারী বাজার চাক্তাই ও পাহাড়তলী বাজার ঘুরে দেখা গেছে, উর্ধমুখী চালের বাজারে আরেক দফায় বেড়েছে জিরাশাইল ও মিনিকেট চালের দাম।
এসব বাজারে গত একমাসের তুলনায় জিরাশাইল চালের দাম বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) সর্বোচ্চ ২৫০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে। ৩৬০০ টাকা হিসেবে প্রতি কেজি জিরাশাইল চাল বিক্রি হয়েছে ৭২ টাকা দরে। ৭৫ থেকে ৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে মিনিকেট আতপ।
কয়েকজন ব্যবসায়ীর সাথে কথা হলে তারা বলেন, উত্তরবঙ্গের চাল ব্যবসায়ী ও মিল মালিকরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চালের দাম বাড়াচ্ছে।
আর পাইকারি বাজার থেকে চাল কেনার পর পরিবহন ব্যয়ের খরচও আমাদের দিতে হয়। ফলে আগের দামের চেয়ে বেশি দামেই বিক্রি করতে হচ্ছে সব ধরনের চাল।
তবে মিল মালিকদের সিন্ডিকেটের বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম রাইস মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রফিক উল্লাহ বলেন, দাম একটু বাড়লেই সবাই ঢালাওভাবে মিলমালিকদের সিডিন্ডকেটের কারসাজি বলে চালিয়ে দেন।
আসল কথা হলো কৃষকরা এখন ধান-চাল বেঁচা-বিক্রিতে আগের চেয়েও অনেক কৌশলী হয়েছে। অনেক কৃষক এখন ধান কেটে বিক্রি না করে নিজেদের গোলায় মজুদ রাখে। বৃষ্টি হলে বেশি দামে কিছু ধান বিক্রি করেন, আবার বৃষ্টি কমলে দাম বাড়ানোর জন্য অপেক্ষা করেন। এই কৌশলের কারণে ধানের দামও এবার কিছুটা বাড়তি। প্রভাব পড়ছে চালের বাজারে।
এদিকে চট্টগ্রামের চালের বাজারে এখন কোন কৃত্রিম সঙ্কট নেই দাবি করে পাহাড়তলী বণিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এস এম নিজাম উদ্দিন জানান, ঈদের আগেও চালের বাজার অনেকটা স্থিতিশীল ছিল।
কিন্তু নতুন বছরে হঠাৎ সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। বোরো ধান পুরোদমে বাজারে আসলে সব ধরনের চালের দাম আবারও কমে যাবে বলে মনে করেন তিনি।
পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন সূত্রকে দায়ী করে পার পেলেও চালের দাম বাড়ার জন্য ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন ভোক্তারা।
চাক্তাই ও পাহাড়তলী বাজারে চাল কিনতে আসা কয়েকজন সাধারণ ক্রেতার সাথে কথা হলে তারা জানায়, বাজারে চালের কোন সংকট নেই। তবু আমাদের বেশি দামে চাল কিনতে হচ্ছে। কারসাজির মাধ্যমেই প্রতি সপ্তাহে চালের দাম বাড়ানো হচ্ছে। শীঘ্রই সরকারি নজরদারি প্রয়োজন।
কনজ্যুমার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস.এম. নাজের হোসাইন জানান, চালের বাজারে কোন সংকট না থাকলেও নিয়মিত দাম বাড়াচ্ছে ব্যবসায়ীরা। দাম বাড়াতে বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ী বিভিন্ন অজুহাত দেখাচ্ছে।
তিনি মনে করেন নিয়মিত বাজার মনিটরিং না থাকায় চালের দাম বাড়াচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। মনিটরিং বাড়ানো হলে চালসহ সব পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
জেএন/পিআর