টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের কারণে হ্রদের পানি বাড়ায় গত ৫ আগস্ট খুলে দেওয়া হয়েছিল রাঙামাটির কাপ্তাই বাঁধের ১৬টি গেট (জলকপাট)।
ফলে রাউজানে হালদা ও কর্ণফুলী নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে করে বেশ কিছু গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং অনেক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।
তবে ধীরে ধীরে হৃদের পানি কমে উচ্চতা ১০৭ দশমিক ৬ ফুটে আসলে এক সপ্তাহ পর গতকাল মঙ্গলবার সকাল আটটার দিকে সব জলকপাট বন্ধ করে দেওয়া হলেও রাউজান উপজেলার কিছু কিছু গ্রামে এখনও জলমগ্ন অবস্থা বিরাজ করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখনও হাঁটুসমান পানি রয়েছে উপজেলার নোয়াপাড়া ইউনিয়নের পশ্চিম নোয়াপাড়া, মোকামীপাড়া, সামমাহালদারপাড়া, ছামিদর কোয়াং, কচুখাইন, দক্ষিণ নোয়াপাড়া, উরকিরচর ইউনিয়নের মইশকরম, সওদাগরপাড়া, সুজারপাড়া, পূর্ব উরকিরচর, খলিফার ঘোনা, বাগোয়ান, পশ্চিম গুজরা ও বৈইজ্জাখালিনোয়াপাড়াসহ আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামে।
ওই সব গ্রামে হাজার হাজার মানুষ এখনও জলাবদ্ধতার শিকার। রাস্তা ও বসতঘরের পাশাপাশি তলিয়ে গেছে ধানের বীজতলা, মাছের পুকুর এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও।
এসব গ্রামের স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা গেছে, জোয়ার ও কয়েকদিনের টানা বর্ষণে কর্ণফুলী ও হালদা নদীর পানি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় গেল সাত দিন ধরেই এমন দুর্ভোগের মধ্যে রয়েছে তারা।
কাপ্তাই বাঁধ বন্ধ করে দিলেও এখনও অন্তত ৩০টিরও বেশি গ্রামে হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। বিভিন্ন এলাকা ও আশেপাশের রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ির পাশাপাশি আমন ফসল ও মাছের কয়েকশ পুকুর ভেসে গেছে। এখনও বন্ধ রয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও কর্মসংস্থান।
খলিফার ঘোনার মাছচাষি সিরাজুল ভুঁইয়া জানান, টানা বৃষ্টি ও নদীর জোয়ারের পানি বৃদ্ধি হওয়ায় তার গ্রামের অধিকাংশ বাড়িঘরে পানি উঠে পড়েছে। সাতদিন অতিবাহিত হলেও এখনও পুরোপুরি পানি নেমে যায়নি।
এদিকে গেল কদিনে তার চাষ করা তিন পুকুরের সকল মাছ জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে। এতে অন্তত চার থেকে ৫ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে দাবী চাষী সিরাজুলের।
সামমাহালদারপাড়ার বাসিন্দা আলেয়া বেগম বলেন, পানির জালায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছি। সকালে পুরো বাড়ি থেকে পানি ও ময়লা পরিস্কার করলেও মাঝরাতে জোয়ারের পানিতে আবারও পানি উঠে যায় বসতঘরে।
এর আগে কয়েকদিন দুপুরেও পানি উঠেছে। তখন রান্না বান্না সব বন্ধ ছিল। কোথা থেকে খাবার আনারও পরিস্থিতি ছিল না। এ কদিন উপবাসে দিন কাটাতে হয়েছে পরিবারের সকলকে। গেল সাতদিন ধরেই এমন দুর্ভোগে দিন কাটাচ্ছে এখানকার শত শত পরিবার।
স্থানীয়দের অভিযোগ, হাটহাজারী অংশে বেড়িবাঁধ থাকলেও রাউজানের নদীপাড়ে কোনো সুরক্ষাবাঁধ নেই। এতে প্রতিবছর অমাবস্যা-পূর্ণিমায় এমন দুর্ভোগ পোহাতে হয় এখানকার বাসিন্দাদের।
বর্ষা মৌসুমে পূর্ণিমা-অমাবস্যার জোতে কখনও দিনের বেলায়, কখনও গভীর রাতে পানিতে তলিয়ে যায় গ্রামগুলো। ডুবে থাকে রাস্তাঘাট, মসজিদ-মাদ্রাসা, স্কুল, এমনকি বসতঘরও।
গেল সাত দিন ধরে পানিবন্দি রয়েছে উপজেলার নদীর তীরবর্তী এলাকায় বসবাসরত হাজার হাজার মানুষ। অনাহারে ঘরবন্দি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে অনেকে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে জোয়ারে গ্রামগুলো প্লাবিত হয়। দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৩টার মধ্যে ভাটায় পানি নামে। মানুষ এসময় ঘরবন্দী হয়ে পড়ে। নদীর তীরে বেড়িবাঁধ না থাকায় প্রতিবছর বর্ষায় এমন দুর্দশা হয় বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
বেশ কয়েকটি গ্রামের ভুক্তভোগীদের সাথে কথা হলে তাদের একটাই দাবি তারা বেড়িবাঁধ চাই। কয়েকজন বলছেন, জোয়ারের স্রোতে রাস্তাগুলো ভেঙে গেছে, গাড়ি চলাচল বন্ধ। চাষের জমি পানিতে ডুবে গেছে, সব ফসল পচে নষ্ট। আমরা খাবার চাই না, আমাদের বেড়িবাঁধ দিন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মুহাম্মদ মাসুম কবির বলেন, জোয়ার ও বৃষ্টির পানিতে বিভিন্ন গ্রামের ধান ও বীজতলার মাঠ মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে। ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা পরিদর্শণ করে কৃষি অফিস থেকে ক্ষয়ক্ষতির তালিকা তৈরি করা হবে।
রাউজান উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জিসান বিন মাজেদ জানান, নদীর পানি বেড়ে অনেক ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। ইতিমধ্যে প্লাবিত ইউনিয়নগুলোতে এক মেট্রিকটন করে চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, মাস্টার রোলের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মাঝে বিতরণ করা হচ্ছে। শুকনো খাবারও বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
পানি নেমে গেলে ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত পরিমাণ নির্ধারণ করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে সহায়তার জন্য বরাদ্দ চাওয়া হবে।
তিনি জানান, রাউজান অংশে মদুনাঘাট থেকে লাম্বুরহাট পর্যন্ত ২ হাজার ১৬৫ মিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণের প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। একনেক সভায় অনুমোদন পেলে চলতি অর্থবছরেই কাজ শুরু হবে।
জেএন/পিআর