ভেল্কি দেখাচ্ছে শীতের উত্তুরে হাওয়া! খেল্ দেখানোয় কম যাচ্ছে না রোদ। এক সপ্তাহ ধরে বাঙলার বুকে শীতের প্রকোপ অব্যাহত। ভরা মাঘে জব্বর শীতালু হাওয়ায় কেন এত মতি চঞ্চল দশা? জয়নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক রুবেল দাশ সরিষা খেতে গিয়ে ভূতের বদলে দেখলেন শীতের স্নিগ্ধ আদুরে রোদ, সাথে ছিলেন নিজস্ব আলোকচিত্রী বাচ্চু বড়ুয়া। যার ক্যামেরায় উঠে এসেছে তারই প্রমাণ-
শীতের হাওয়া ধাক্কা দিয়েছে বাঙলার বাতাসে। হাওয়াবদলের ফাঁদে তাই বাঙালির মন এখন উুঁড়ু উুঁড়ু। গ্রামের মাঠে এখন হলুদ সরিষার রাজত্ব। প্রকৃতি বিছিয়েছে হলুদ গালিচা। শহরের ইট-পাথরের দালান ছেড়ে একটু গ্রামের দিকে বেড়িয়ে পড়লেই চোখে পড়বে প্রকৃতির এই অপূর্ব দৃশ্য। যে দিকেই চোখ যাবে শুধুই হলুদ আর হলুদ। সরিষা ক্ষেতে ভূত নয়, দেখা মিলবে অপার আদুরে রোদ। গ্রাম-বাংলার চারপাশ এখন সরিষা ক্ষেতে ঢাকা।
মাঘের শীতের সকালে শিশির ভেজা ফসলের মাঠের এমন সৌন্দর্য চট্টগ্রামের উপজেলাগুলোতে। বিশেষ করে রাউজান, হাটহাজারী, ফটিকছড়ি, রাঙ্গুনিয়া-এ উপজেলাগুলোতে ভালোই চাষ হচ্ছে সরিষার। সরিষা ক্ষেতের সন্ধান পেতে ছুটে গেলাম রাউজান উপজেলার গহিরা ইউনিয়নে। এ ইউনিয়নের উত্তর সর্তা গ্রামের বিভিন্ন মাঠ-বিল এখন হলুদ সরিষায় ভরা। রাউজান উপজেলার স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, মৌসুম এখন সরিষার। তাই গ্রামে মাঠের পর মাঠ সরিষার আবাদ হয়েছে। হলুদে ছেয়ে গেছে আদিগন্ত ফসলের ক্ষেত। মাঠজুড়ে তাই ফুলের মধু আহরণে ব্যস্ত মৌমাছিরা গুনগুনিয়ে ফুল থেকে ফুলে উড়ে বেড়াচ্ছে। হিম কুয়াশায় মোড়ানো সর্ষের ক্ষেত নয়ন জুড়িয়ে দেয়। ঘোর-লাগা কুয়াশা বিদায় নিয়ে সূর্য যখন উঁকি দেয় পুব আকাশে তখন দুই চোখ হলুদাভ উজ্জ্বল রঙে ডুব দেয়। যেন তেন হলুদ নয়, একবারে স্বর্ণাভ হলুদ। সরিষা ক্ষেতের সেই হলুদ রং যেন আকাশে মিশেছে, সঙ্গে কচি সরষে ফুল দুলছে উত্তরের হাওয়ায়।
মাঘের শীত তীব্রভাবে জেঁকে বসেছে মাঠে ঘাটে। শীত তার হাল্কা স্পর্শ নিয়েই কাবু করে দিচ্ছে মানুষকে। সরিষা ক্ষেত যেমন চোখের বিনোদন, তেমনি পেটের ক্ষুধা নিবারণেও রয়েছে সরিষার ভূমিকা। শুধু সৌন্দর্যের মন্ত্রই নয়, সরিষার মধু ও তেল বাঙালির পাতে নিয়ে আসে বাড়তি স্বাদ। শীতের নানাবিধ টাটকা সব্জির সাথে সরিষার ভেষজগুণ নিয়ে বললেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও দেশের বিশিষ্ট উদ্ভিদবিজ্ঞানী ড. কামরুল হুদা। জয়নিউজের সাথে আলাপে তিনি বলেন, সরিষা থেকে আমরা দুটো জিনিস পাই। একটি মধু, অপরটি তেল। মধুর ভেষজগুণ চমৎকার, যা উদ্ভিদবিদ্যার ভাষায় সর্বরোগহারী মাহাষৌধী। শীতে শরীরে বাড়তি তাপের জোগান দেয়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণ করে। সরিষার তেল গায়ে মাখলে হাড় মজবুত করে এবং ত্বকের ঔজ্বল্য বৃদ্ধি করে, চুলের বাহার ঘটায় এবং মাথা ঠাণ্ডা রাখে।
উত্তর সর্তার ধনা বিল ও কানকু বিলে এবার বেশ ভালো চাষ হয়েছে সরিষার। ধীরে ধীরে এ বিল দু’টির সরিষা ক্ষেতের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে চোখ জুড়িয়ে যায়। নাকে আসতে থাকে সরিষার সৌরভ। সেই সৌরভে রয়েছে ভিন্ন ধরনের এক মাদকতা। সম্ভবত সেই মাদকতার কারণেই মৌমাছিরা ভিড় জমায়। দূর থেকেই বোঝা যায় এর জৌলুস। কাছে আসতেই দেখা মিলবে প্রকৃতির আরেক বিস্ময়! হলুদ রাজ্যে মৌমাছির ব্যস্ততা।
মনে হবে কবিতার পংক্তি ‘মৌমাছি মৌমাছি, কোথা যাও নাচি নাচি, দাঁড়াও না একবার ভাই, ওই ফুল ফোটে বনে, যাই মধু আহরণে, দাঁড়াবার সময়তো নাই…।” মধুসমৃদ্ধ ফুলের খোঁজে ওদের সারাক্ষণ ছুটাছুটি। চষে বেড়ায় দূর-দূরান্ত। উদ্দেশ্য একটাই- মধু সংগ্রহ করা। আর ওরা নিজেদের অজান্তেই ঘটিয়ে চলে ফুলের পরাগায়নের কাজটি। তবে মাঠের কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেল, মন ভালো নেই তাদের। প্রতিবছরই দাম কমছে সরিষার। ফলে লাভ তেমন হচ্ছে না। তাই গতবারের চেয়ে এবার একটু কমই চাষ হয়েছে সরিষার। কানকু বিলের কৃষক নুরুল আলম জয়নিউজকে বলেন, শ্রাবণ মাসের শেষের দিকে সরিষার বীজ রোপন করা হয়। আর গাছ থেকে তেল বীজ পাওয়া যায় মার্চ মাসে। এখনই গাছগুলোতে ফল আসা শুরু করেছে।
তবে আক্ষেপ নিয়ে তিনি বলেন, দুই থেকে তিন বছর আগে এক আঁটি সরিষা বিক্রি হত ৮০০ টাকায়। এখন সে সরিষার দাম নেমে এসেছে ৬০০ টাকায়। এছাড়া সরিষা থেকে যে তেল পাওয়া যায় তা কেজিতে ৩০০-৪০০ টাকায় বিক্রি করি। কিন্তু এবার বাজারে দেখছি তেলের দামও কমে গেছে। দাম কমে যাওয়ায় আমরাও চাষ কমিয়ে দিয়েছি। এভাবে চলতে থাকলে হয়ত আর সরিষা চাষই করব না। তিনি জানান, সরিষা গাছ ভালো থাকার জন্য ক্ষেতে লাল পটাশ ও সাদা পটাশ প্রয়োগ করা হয়। আরেক সরিষা কৃষক মো. রুবেল জয়নিউজকে বলেন, গত বছর আমি ৩০ গণ্ডা জমিতে সরিষা চাষ করেছিলাম। এবার করেছি ২০ গণ্ডায়। কারণ তেমন ভালো দাম পাচ্ছি না। সরকার যদি এ বিষয়টাতে একটু নজর দিত তাহলে হয়ত আমরা সরিষার ন্যায্য দাম পেতাম।