বাঙালির ক্যালেন্ডারে অভিশপ্ত মাস আগস্ট। শোকের মাস আগস্ট। শোকের শ্রাবণ এই ধরণীর বুকে বাঙালির হাহাকার বাড়িয়ে দেয় অঝোর অশ্রু ধারায়। শোক আর শ্রাবণ বাঙালির ললাটে প্রিয়জন হারানোর মাস। না চাইলেও ক্যালেন্ডারের পাতা ঘুরে বারবার অশ্রু নিয়ে আসে যে মাস।
সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট আমরা হারিয়েছি সপরিবারে। এক নৃশংস মর্মন্তুদ হত্যাকাণ্ড, যা বাঙালির হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটায়। রচিত হয় বাঙালির ইতিহাসে কালো দাগ।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ৭ মে ১৮৬১। তাঁরও চলে যাওয়া ৭ আগস্ট ১৯৪১। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম যিনি ১৮৯৯ সালে জন্মে, মৃত্যুবরণ করেন এই অগাস্টেরই ২৯ তারিখ, বঙ্গবন্ধু খুন হওয়ার পরের বছর। বাঙালির আরেক বিশ্বসন্তান, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু। যিনি জন্মেছেন ১৮৯৭ সালে, এক রহস্যময় ভ্রমণপথে তিনি অন্তর্ধান করেন ১৮ আগস্ট তারিখে, ১৯৪৫ সালে। এইসব বাঙালি মনিষী একে একে চলে যাওয়া সবই অগাস্টের বর্ষণসিক্ত বেদনায়।
ব্রিটিশবিরোধী অগ্নিযুগের বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুও ফাঁসিতে আত্মাহুতি দিয়েছেন ১১ আগস্ট তারিখ ১৯০৮ সালে। সারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ত্রাস হিসেবে তিনি সেদিন বীরের মৃত্যু বেঁছে নিয়েছিলেন। পরাধীনতার শোষণ ও যাঁতাকল ভাঙ্গতে যিনি স্বদেশী ভারতীয়দের স্বাধীনতা আন্দোলনের ছিলেন প্রেরণাশক্তি।
বাংলাদেশের প্রধানতম কবি শামসুর রাহমান। বাঙালীর শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজন । শামসুর রাহমান ১৯২৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট কবি ছেড়ে যান এই বাঙালিলোকের মায়া। শামসুর রাহমান বিংশ শতকের ত্রিশ দশকের পাঁচ শ্রেষ্ঠ কবির পর আধুনিক বাংলা কবিতার প্রধান পুরুষ হিসেবে প্রসিদ্ধ। সাড়া জাগানো চলচ্চিত্র পরিচালক তারেক মাসুদ, ১৯৫৬ সালে জন্ম যার, তিনিও ১৩ই অগাস্ট ২০১১ সালে নির্মমভাবে মারা যান ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায়।
তারেক মাসুদের শবযাত্রায় সঙ্গী হয়ে শোকের তীব্রতা বাড়িয়েছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক মিশুক মুনীর। পুরোনাম আশফাক মুনীর চৌধুরী। যিনি ১৯৫৯ সালে জন্ম গ্রহণ করেন শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর মেজ ছেলে হয়ে। প্রথাভাঙ্গা সাহিত্যক হুমায়ুন আজাদের জন্ম ২৮ এপ্রিল ১৯৪৭। প্রকৃতির নির্মম খেয়ালে ১১ আগস্ট ২০০৪ তারিখে; বাইশে শ্রাবণ বাংলাদেশী এই কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, সমালোচক, গবেষক, ভাষাবিজ্ঞানী, কিশোর সাহিত্যিক এবং রাজনৈতিক ভাষ্যকার মারা যান। এদিকে ২০১৮ সালের ১৩ আগস্ট মারা যান বরেণ্য সাংবাদিক দৈনিক সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার।
এভাবেই বাঙালি শ্রাবণের ভরা বরষণে একে একে হারিয়েছে তার শ্রেষ্ঠ সন্তানকে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড ছুড়ে হত্যার চেষ্টা হয়েছিল জাতির জনকের কন্যা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। ভাগ্যক্রমে সেদিন তিনি বেঁচে গেলেও ওই ঘটনায় সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের সহধর্মিনী, আওয়ামী লীগের ওই সময়ের মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত এবং পাঁচ শতাধিক নেতা-কর্মী আহত হন। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলা বাঙালির জীবনে সন্ত্রাসের তিলক লাগিয়ে দেয়। সেদিন মুন্সিগঞ্জ ছাড়া দেশের ৬৩ জেলায় বোমা হামলা করে জেএমবি।
বাঙালির ক্যালেন্ডারে অভিশপ্ত মাস আগস্ট। শোকের মাস আগস্ট। আগস্ট তাই নিয়ে আসে বাঙালির পরমাত্মীয় হারানোর তীব্র কষ্ট।