১৯৭১ সালে স্বাধীনতাবিরোধী অবস্থানের কারণে জামায়াতে ইসলামীকে জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনার পরামর্শ দিয়ে দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক দল থেকে পদত্যাগ করেছেন। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে শীর্ষ জামায়াত নেতাদের আইনজীবী দলের নেতা ছিলেন তিনি। পদত্যাগের পর বিবিসি বাংলার ফেসবুক লাইভে জামায়াত ও ব্যক্তিগত বিষয়ে কথা বলেছেন ব্যারিস্টার রাজ্জাক।
বিবিসির সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান, জামায়াতে আর ফিরবেন না। আপাতত অন্য কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দেওয়ারও ইচ্ছে নেই তাঁর। রাজনৈতিক দলের বাইরে থেকে দেশের জন্য কাজ করার আরও অনেক ক্ষেত্র রয়েছে জানিয়ে ওই জায়গাগুলো থেকেই দেশের জন্য অবদান রাখতে চান তিনি।
বর্তমানে চরম সংকটাপন্ন অবস্থার মধ্যে রয়েছে জামায়াত। এই পরিস্থিতিতে কেন দলত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলেন- এমন প্রশ্নের জবাবে রাজ্জাক বলেন, আমি দীর্ঘ তিরিশ বছর জামায়াতের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম। দলটির আইন ও কূটনৈতিক বিষয়ে কাজ করেছি। ১৯৯২ সালে গোলাম আজমের নাগরিকত্ব মামলায় আমি জুনিয়র আইনজীবী ছিলাম। এছাড়া সাইদী, নিজামী ও মুজাহিদের মামলাও লড়েছি।
২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত জামায়াতের শীর্ষ দশ নেতার মামলার প্রধান কৌঁসুলি হিসেবে কাজ করেছি। সুতরাং আমার যে কাজ ছিল জামায়াতকে আইনগত ও কূটনৈতিক সহযোগিতা করা, তা আমি সততার সঙ্গে করেছি। আমার জামায়াতে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল দলটিকে সংস্কার করা। কিন্তু আমি তাতে ব্যর্থ হয়েছি।
রাজ্জাক বলেন, আমি আমার পদত্যাগপত্রে প্রতিটি পয়েন্ট উল্লেখ করেছি। ২০০১ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত আমি কি করেছি তার সবই উল্লেখ রয়েছে। সেখানে আমি জামায়াতকে যেন একাত্তরের বোঝা বহন করতে না হয়, সেজন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। কিন্তু যখন আমি দেখলাম যে আমার আর কিছু করার নেই, জামায়াতকে আমার দেওয়ার মতো কিছু নেই, তখন পদত্যাগ করেছি।
একাত্তরে জামায়াতের ভূমিকার জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত বলে জানিয়েছেন তিনি। কিন্তু এই কথাটি জামায়াতের অন্য নেতারা কেন বুঝছেন না- এমন প্রশ্নের জবাবে আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি তাদেরকে বোঝানোর। ইতিহাস থেকে উদাহরণ দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে স্বাধীনতার বিরোধিতা করে কোনো দেশে কোনো দল সে দেশের নেতৃত্ব দিতে পারেনি। তবে এ সময় দলের নেতাদের মধ্যে বিভক্তি দেখা দেয়। কিছু লোক এ কথার পক্ষে ছিলেন, কিছু বিপক্ষে।
তিনি বলেন, জামায়াতে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্তের ব্যাপারে বেশিরভাগ লোকের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের কারণেই জামায়াতে ইসলামী জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেনি।
রাজ্জাক বলেন, আমি বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত বিপক্ষে গেলেও, এটা আমাদের করা উচিত। কেন না আমরা নেতৃত্বে রয়েছি। আমি নেলসন ম্যান্ডেলার উদাহরণ দিয়েছি, সংখ্যাগরিষ্ঠরা শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চাইলেও তিনি চুক্তি করেছিলেন। জামায়াতের কিছু নেতা আমার কথা বুঝলেও তারা এটা করতে অপারগ হয়েছেন এবং এটি তাদের ব্যর্থতা।
জামায়াতের বর্তমান অবস্থা ও দল বিলুপ্তির বিষয় সম্পর্কে রাজ্জাক বলেন, জামায়াতের বিরুদ্ধে একাত্তরের একটি কালিমা রয়েছে। এছাড়া ২০১১ সাল থেকে দলের কার্যক্রম প্রকাশ্যভাবে সব বন্ধ। বাংলাদেশের ৬৫টি অফিসের সবগুলোই বন্ধ।
তিনি বলেন, সব অফিস বন্ধ, জামায়াতের নিবন্ধন নেই, নির্বাচনের প্রতীক নেই, তারা কোনো মিছিল-মিটিং করতে পারে না। যেহেতু এর কোনোটিই জামায়াত করতে পারছে না, সেহেতু জামায়াতের নতুন করে ভাবা উচিত।
কোনো চাপের কারণে জামায়াত ছেড়েছেন কি না- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি তা অস্বীকার করেন। তার ওপর কোনো চাপ নেই বলেও জানান তিনি। এছাড়া ১৯৯১ সালে জামায়াত সবচেয়ে ভালো অবস্থানে ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, সে সময়ও আমি জামায়াতকে দেশের কাছে ক্ষমা চাওয়ার বিষয়ে বলেছিলাম।
যদি আপনার পক্ষে জামায়াতের বেশিরভাগ নেতা থাকতেন, তাহলে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে গিয়ে আপনি কি বলতেন বা জামায়াতের এ বিষয়ে কি বলা উচিত-এমন প্রশ্নের জবাবে আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমি পরিষ্কার বলতাম যে আমরা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছি। এটা আমাদের একটা রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। এজন্য আমরা জাতির কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাচ্ছি। কোনো অজুহাত না দিয়ে আমাদের এটাই বলা উচিত।
ক্ষমা চাওয়ার অর্থ হলো আপনি জামায়াতের দলীয় মতামতকে উড়িয়ে দিচ্ছেন। বিপক্ষের লোকেরা এটা কিভাবে নেবে-জানতে চাইলে রাজ্জাক বলেন, ১৯৪০ সালের জামায়াত, ১৯৪৭ সালের জামায়াত, ১৯৭১ সালের জামায়াত এবং একবিংশ শতাব্দীর জামায়াত এক হতে পারে না। অবশ্যই কৌশল পরিবর্তন করতে হবে। যেমনটি তুরস্ক ও তিউনিশিয়ায় দেখা গেছে।
তুরস্ক ও তিউনিশিয়ার ইসলামপন্থি দলগুলো তো সে দেশের স্বাধীনতার বিরোধী ছিল না, তাদের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ ছিল না- এ বিষয়ে রাজ্জাক বলেন, তাদের বিরুদ্ধে ছিল না কিন্তু আমাদের বিরুদ্ধে রয়েছে। কোনো রাজনৈতিক দলের অতীতে যদি কোনো ভুল থাকে, তার জন্য জনগণের কাছে ক্ষমা চাইতে কোনো সংকোচ থাকা উচিত নয়।
ফেসবুকে একজন রাজ্জাকের কাছে জানতে চান, তিনি অন্য কোনো দলে যোগদান করবেন কি না? জবাবে তিনি বলেন, আমি আমার পেশায় ফিরে যাব এবং একজন নাগরিক হিসেবে দেশের উন্নয়নে যে অবদান রাখার তা রাখব। এটি করার জন্য কোনো দলে যোগদান করবেন কি না-জানতে চাইলে রাজ্জাক বলেন, দেশের উন্নতিতে অবদান রাখতে গেলে কোনো দলে যোগদান করা জরুরি নয়। দেশ এবং জাতির জন্য আমার কিছু করার আছে।
আর কারও জামায়াত ছাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে রাজ্জাক বলেন, এ সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। আমি ব্যক্তিগতভাবেই পদত্যাগ করেছি। কোনো নতুন দল গঠন করবেন না বলেও জানান তিনি।
জামায়াতকে বিলুপ্ত করা হলে যারা দলটির সমর্থক তারা কি করবে-এমনটি জানতে চাইলে রাজ্জাক বলেন, ইসলামী রাষ্ট্রের যে ধারণা ছিল সে সম্পর্কে যুবসমাজের একটু চিন্তাভাবনা করা উচিত। পৃথিবীতে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। মুসলিম বিশ্বে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের অধীনে কিভাবে দেশের উন্নতি করা যায়, যুবসমাজকে সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা করতে হবে।
ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানে থাকা অবস্থায় ইসলামী রাজনীতি করা সম্ভব কি না জানতে চাইলে রাজ্জাক বলেন, অবশ্যই সম্ভব। কারণ ইসলামী রাজনীতির মূল কথাটা হলো জনগণের কথা। জনগণের জন্য কাজ করার ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ সংবিধান কোনো বাধা নয়।
জামায়াত না থাকায় এর সঙ্গে থাকা দলগুলো সংকটে পড়বে কি না-এ বিষয়ে রাজ্জাক বলেন, তারা সংকটে পড়বে কি না তা জানি না। তবে জামায়াতকে বিলুপ্ত করার সময় এসেছে। এটি দেশের জন্য কল্যাণকর, জামায়াতের জন্য কল্যাণকর এবং জাতির জন্য কল্যাণকর।
ধর্মে নারী নেতৃত্ব হারাম। তাহলে নারীদের কিভাবে জামায়াত দলের শীর্ষ পর্যায়ে আনবে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জামায়াতের শীর্ষ দুই নেতা নারী নেতৃত্বকে মেনে নিয়ে মন্ত্রীর শপথ নিয়েছিলেন। এছাড়া মজলিশে সুরাতে নারী সদস্য রয়েছে। অর্থাৎ জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে নারীদের অংশগ্রহণ রয়েছে। সেটিকে আরও কার্যকর করতে হবে। এই পরিবর্তনের চিন্তা ইসলামী দলগুলোকে করতে হবে।
সবশেষে তিনি বলেন, যদি জামায়াত জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, তাহলে দেশ ও রাজনীতিতে দলটি অনেক মূল্যবান অবদান রাখতে পারবে।
জয়নিউজ/অভিজিত/বিশু/আরসি