চট্টগ্রামের একজন সাহসী নারী ভাষাসৈনিকের নাম প্রতিভা মুৎসুদ্দি। অথচ বন্দরনগরের অনেকেই জানেন না তাঁর নাম। ১৯৫২ সালে অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় উর্দু ভাষার প্রতিবাদে নেমে এসেছিলেন রাস্তায়। তবে চট্টগ্রামের মেয়ে হলেও এখন বাস করেন টাঙ্গাইলে।
১৯৩৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে জন্ম নেন এ ভাষা সংগ্রামী। ছোটবেলায় তার স্কুলজীবন শুরু হয় রাউজানের মহামুনী অ্যাংলো পালি ইনস্টিটিউশনস-এর মাধ্যমে। বাবা কিরণ বিকাশ মুৎসুদ্দি তাঁর সময়ের একজন প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী। মা শৈলবালা মুৎসুদ্দি ছিলেন গৃহিণী। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগ, ভাষার দাবিতে আন্দোলিত সময়ে বেড়ে উঠেছেন প্রতিভা মুৎসুদ্দি। তাঁর শিক্ষাজীবনের সময়টি ছিল সমাজের অবহেলিত ও নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষায় সোচ্চার ও তাত্ত্বিক ব্যঞ্জনাময় আন্দোলনের বেগবান সময়। তখনকার চট্টলা, বিপ্লবী ও সত্যাগ্রহীদের সুতিকাগার এবং চারণক্ষেত্র হিসেবে বিশেষভাবে আন্দোলিত। পারিবারিক মূল্যবোধ ও সময়ের এ মহার্ঘ চালিকা শক্তি প্রতিভা মুৎসুদ্দির শিক্ষা ও মননের বিকাশকে প্রভাবিত করেছে।
তাঁর রাজনীতিতে হাতেখড়ি গ্রামের স্কুলে। কলেজ জীবনে ভাষা আন্দোলনের হাত ধরে আরো ঘনিষ্ঠ হয়েছেন রাজনীতি তথা জীবন ঘনিষ্ঠ বামপন্থী রাজনীতিতে। জড়িয়ে পড়েন বিভিন্ন সেবা ও কল্যাণধর্মী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে।
শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদানের জন্য তিনি ২০০২ সালে একুশে পদক পান। একুশে পদক ছাড়াও ১৯৮৭ সালে বেইস এর আজিজুর রহমান পাটোয়ারী পদক, ১৯৯৫ সালে অনন্যা শীর্ষ দশ পদক, ১৯৯৬ সালে লায়ন নজরুল ইসলাম শিক্ষা স্বর্ণপদক, ১৯৯৮ সালে দ্যা রোটারি ফাউন্ডেশনে অব রোটারি ইন্টারন্যাশনাল-এর পল হ্যারিস ফেলো পদক, ২০০০ সালে বৌদ্ধ একাডেমি পুরস্কার এবং ২০০৩ সালে ইন্টারন্যাশনাল ব্রাদারহুড মিশনের ধর্মবীর পদক ও ২০০৬ সালে বিশুদানন্দ স্বর্ণপদকসহ বিভিন্ন পদকে ভূষিত হয়েছেন এই ভাষা সৈনিক।
৫২’র ভাষা আন্দোলনের কথা স্মৃতিচারণ করে ভাষা সৈনিক প্রতিভা মুৎসুদ্দি বলেন, ১৯৪৮ সালে গ্রামের স্কুলে থাকাকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন বক্তৃতা করেছিলেন ‘উর্দু শুধু উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’, এ অন্যায় ঘোষণার প্রতিবাদে না, না, না বলে ফেটে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা। চট্টগ্রামে মাহবুব উল আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলন সংগ্রাম কমিটি গড়ে ওঠে। আমি তখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। সেই সময় আমার ভাইয়েরা সব বামপন্থী ছাত্র রাজনীতি করতো। যার কারণে ভাষা আন্দোলনে ঝুঁকে পড়ি।
তিনি আরও বলেন, ১৯৫১ সালে চট্টগ্রামের ডা. খাস্তগীর স্কুল থেকে এসএসসি পাসের পর চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হই। ১৯৫২ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলাম। ভাষার দাবিতে আমি মাহবুবুল আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে বিক্ষুব্ধ ছাত্রসমাজের সঙ্গে আন্দোলনে অংশ নেই। পোস্টার লিখি, অভিভাবকদের বাধাকে উপেক্ষা করে মাতৃভাষার দাবিতে রাজপথে নামি। চট্টগ্রাম রাষ্ট্রভাষা কমিটির আহ্বায়ক মাহবুব উল আলম চৌধুরীর আহ্বানে ৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের সব শিক্ষার্থীর সঙ্গে ধর্মঘট পালন, মিছিল ও লালদিঘীর ময়দানে সভায় অংশ নিই।
আন্দোলনমুখর সেই দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করে এই ভাষা সৈনিক আরো বলেন, ১৯৫৪ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে অর্থনীতিতে সম্মান প্রথম বর্ষ শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি। এরপর ভাষা সৈনিকরা আন্দোলনের নানা কর্মসূচি পালন করতে করতে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়। ১৯৫৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রবেশ করতে না দেওয়ার খবর পেয়ে আমি ৫-৬ জন ছাত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আম তলে ছুটে যাই। হঠাৎ পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করে। তখন লাইব্রেরিতে পালানো ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না আমাদের। পরে বিকেলে আমরা লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে আর তখনি আমরা স্লোগান দিই, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। পুলিশ আমাদের ৬-৭ জনকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। তবে সপ্তাহ দুই পর আমরা কারাগার থেকে মুক্তি পাই।
প্রতিভা মুৎসুদ্দি ১৯৫৫ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মহিলা মিলনায়তন সম্পাদিকা এবং ১৯৫৬-১৯৫৭ সালে উইমেন্স হলের (বর্তমান রোকেয়া হল) প্রথম সহসভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫৯ সালে অর্থনীতিতে মাস্টার্স ডিগ্রি, ১৯৬০ সালে ময়মনসিংহ মহিলা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বিএড ডিগ্রি লাভ করার পর কক্সবাজার উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করেন এবং নকলের প্রতিবাদে তা বাদ দিয়ে ১৯৬১ সালে গাজীপুর জেলার উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে চলে আসেন এবং এখানেও কিছু জটিলতার কারণে ক্ষোভে এ চাকরিও ছেড়ে দেন প্রতিভা মুৎসুদ্দি। পরে ১৯৬৩ সালে তিনি দানবীর রনদা প্রসাদ সাহার ভারতেশ্বরী হোমসে অর্থনীতির প্রভাষক হিসেবে কাজ শুরু করে পরবর্তীতে ১৯৬৫ সালে অধ্যক্ষের দায়িত্ব নেন। দীর্ঘ ৩৪ বছর পর ১৯৯৯ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৮৫ সালে তাকে কুমুদিনী কল্যাণ সংস্থার পরিচালক এবং কুমুদিনী ট্রাস্টের শিক্ষা উপদেষ্টার দায়িত্ব দেওয়া হয়।