বীভৎস এক খুনের খবরে শুরু করা যাক। ঝগড়া হয়েছিল, তাই গলা টিপে স্ত্রী-শাশুড়িকে হত্যা করেন মতিন!
ক’দিন আগেই স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে ও বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক মানতে না পেরে তাকে জবাই ও ছুরিকাঘাতে খুন করেন স্ত্রী আশা!
ভাটিয়ারির ঘটনা ভিন্ন, কিন্তু নেপথ্যের কারণ প্রায় একই। স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন গৃহবধূ সাথী!
কথা হচ্ছিল গত পাঁচ মাসে চট্টগ্রামের ৩ আলোচিত পারিবারিক কলহে সৃষ্ট অপরাধ নিয়ে। এই প্রতিবেদন যখন লেখা হচ্ছে, ঠিক সেদিনই (মঙ্গলবার) পারিবারিক কলহের জের ধরে রিপা নামের এক গৃহবধূকে ছুরিকাঘাত করেছেন তার স্বামী!
পারিবারিক কলহের জের ধরে এমন নৃশংস ঘটনা বন্দরনগরে এখন নিত্য চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। পারিবারিক মতানৈক্যের কারণে প্রতিদিন বিবাহবিচ্ছেদ, নির্যাতন, আত্মহত্যা এমনকি হত্যার মত ঘটনাও ঘটছে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অবিশ্বাস-ভুল বোঝাবুঝি এখন তাই অনেক ক্ষেত্রে পৌঁছে যাচ্ছে চরম সহিংসতার পর্যায়ে।
বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার, স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক বোঝাপড়ার অভাব এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ ও অনুশাসন না মেনে চলা এই পারিবারিক সহিংসতাগুলোর পিছনের প্রধান কারণ।
গত বছরের ৩০ অক্টোবর পারিবারিক কলহের জেরে নগরের পাঠানটুলীতে স্ত্রী পারভিন ও শাশুড়ি হোসনে আরাকে গলা টিপে হত্যা করেন স্বামী মতিন। পারভিনকে হত্যার সময় তার মা পাশের কক্ষেই ছিলেন। আর হত্যার সময় মা হোসনে আরা দেখে ফেললে তাকেও হত্যা করেন মতিন। পুলিশের তদন্তে জানা যায়, মাদকাসক্ত মতিন প্রায় সময়ই তুচ্ছ কারণে স্ত্রীকে মারধর করতেন। বর্তমানে মতিন কারাগারে আছেন।
স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে গত ২২ জানুয়ারি সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারিতে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন গৃহবধূ সাথী আক্তার (১৯)। পারিবারিক নানা বিষয় নিয়ে স্বামী কামরুল ইসলামের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিল সাথীর। তারা ভাটিয়ারি বিএম গেট এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন।
গত ১৬ ফেব্রুয়ারি সকালে নগরের পাহাড়তলীতে স্বামী শামীমকে ঘুমন্ত অবস্থায় ছুরি দিয়ে হত্যা করেন স্ত্রী আশা। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আশা জানান, গত এক বছর আগে মো. শামীমের সঙ্গে ফেসবুকের মাধ্যমে তার পরিচয় হয়। একপর্যায়ে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরে তারা বিয়ে করেন। বিয়ের পর আশা জানতে পারেন, তার স্বামী আগে আরও একটি বিয়ে করেছেন। ওই সংসারে তার দুটি ছেলে রয়েছে।
আশা তার স্বামী শামীমকে একান্ত নিজের করে না পাওয়ার বেদনা, দুই সংসারের টানাপোড়েন এবং আরো একাধিক মেয়ের সঙ্গে ভিকটিমের মেলামেশা থাকায় ক্ষোভের বশে তার স্বামীকে হত্যা করার জন্য পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী গত ১৬ ফেব্রুয়ারি সকালে পাহাড়তলীতে নিজেদের ভাড়া বাসায় তিনি জবাই ও ছুরিকাঘাত করে স্বামী শামীমকে হত্যা করেন।
সর্বশেষ, মঙ্গলবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) পারিবারিক কলহের জের ধরে রিপা আক্তার (২৭) নামে এক গৃহবধূকে ছুরিকাঘাত করে গুরুতর আহত করেছেন স্বামী। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে রিপার পেটে ছুরি মেরে পালিয়ে যান স্বামী মনির। পরে তাকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার অবস্থা গুরুতর বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
রিপা নগরের নয়াবাজার মৌসুমী আবাসিকের রওশন ভিলায় স্বামীর সঙ্গে থাকতেন। রিপা এনজিও ইপসার একজন কর্মী ছিলেন। বর্তমানে হাসপাতালের ক্যাজুয়াল্টি ওয়ার্ডে রিপার চিকিৎসা চলছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক বিপ্লব কুমার দে জয়নিউজকে বলেন, পারস্পরিক বোঝাপড়ার অভাব, নৈতিক অবক্ষয়, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও অনুশাসন না মানার কারণেই পারিবারিক কলহ দিন দিন বেড়েই চলেছে। অবস্থা এমন হয়েছে এক ঘরে থেকেও যেন দুজন দু’জনের থেকে অনেক দূরে। পারস্পরিক আস্থাহীনতা ও সন্দেহের কারণেই এ ধরনের ঘটনাগুলো প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে।
পারিবারিক কলহ প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেন, স্বামী-স্ত্রী নিজেদের মধ্যে একান্তে সময় কাটাতে হবে, একসঙ্গে ঘুরতে যেতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কখনোই বেশি আসক্ত হওয়া যাবে না। বুঝতে হবে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের জীবনের একটি অংশ, কিন্তু জীবন নয়। তবে এতে যদি আসক্তি চলেই আসে তাহলে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা আছে। স্বামী-স্ত্রী’র নানা পারিবারিক বিষয় সমাধানেও ‘কাপল কাউন্সিলিং’ এর সুবিধা আছে অনেক স্থানে। এসব বিষয় খেয়াল রাখলে পারিবারিক কলহ অনেকাংশেই কমে যেতে পারে।