‘নিজাম ভাই নেই!’ মাত্র তিনটি শব্দ ঘুরে-ফিরছে চট্টগ্রামের চেরাগীমুখি আড্ডাবাজ তরুণদের মুখে। চেরাগি হলো চট্টগ্রামের চিরপরিচিত আড্ডাবাজ, বইপড়ুয়া, সিনেমাপ্রেমীদের আড্ডার জনপরিসর। নিজাম উদ্দিন সেই আড্ডার একজন। তাঁর অকাল মৃত্যুর সংবাদ মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকেই ফেসবুকে চাউর হয়। অবিশ্বাস্য এই মৃত্যু সংবাদে চট্টগ্রামের সংস্কৃতি অঙ্গনে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। সোমবার (২৫ মার্চ) আকষ্মিক হৃদরোগে ঢাকায় মারা যান নিজাম উদ্দিন।
মঙ্গলবার সকালে চট্টগ্রামের রুমঘাটায় প্রথমবার ও পৈত্রিক ভিটা সাতকানিয়ায় দ্বিতীয় নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। সাতকানিয়ায় পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় তাঁকে। নিজাম উদ্দিন ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৩ তম ব্যাচের মেধাবী শিক্ষার্থীদের একজন। ২০০১ সালে চবির লোকপ্রশাসন বিভাগ থেকে মাস্টার্স পাশ করে নানামুখি সংস্কৃতি কর্মকাণ্ডে যুক্ত রেখেছিলেন নিজেকে। চট্টগ্রামের জামালখানে ‘অযান্ত্রিক’ নামে একটি অধুনা সংস্কৃতিমুখি বিপননকেন্দ্রর উদ্যোক্তাদের একজন তিনি। বইপড়ুয়া হিসেবে খ্যাতি ছিলো তাঁর।
মননশীল পুস্তক বিপনীকেন্দ্র ’বাতিঘর’র সত্ত্বাধিকারী দীপঙ্কর দাশ ফেসবুকে শোক প্রকাশ করেছেন নিজাম উদ্দিনকে ‘আপনজন’ হিসেবে। চবি লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক দুই সভাপতি অধ্যাপক হোসাইন কবীর ও অধ্যাপক ড. কাজী খসরুল আলম কুদ্দুসী তাঁদের প্রিয় এই শিক্ষার্থীর অকাল প্রয়ানে ফেসবুকে শোকানুভূতি জানিয়েছেন। পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশন এলামনাই এসোসিয়েশন’র পক্ষ থেকে শোক প্রস্তাব, পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন ও তাঁর বিদেহি আত্মার মাগফেরাত কামনা করা হয়েছে।
জানা যায়, প্রায় দেড় যুগ আগে ছাত্রজীবনে চট্টগ্রামের বাম ছাত্রআন্দোলনে সক্রিয় নিজাম উদ্দিন কতোয়ালী থানা ও নগর সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের নেতা ছিলেন। ছাত্রজীবনের শেষে ব্যক্তিজীবনে প্রবেশেরক্ষণে কিছুদিন তিনি চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সংগঠক হিসেবে কাজ করেছিলেন। কিন্তু বোহেমিয়ান জীবনধারা ও মুক্তিমুখিন তৎপরতায় সক্রিয় বাম রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন তিনি। চট্টগ্রামের দেওয়ানবাজার এলাকার রুমঘাটায় নিজাম উদ্দিনের পৈত্রিক বাড়ি। তবে, দীর্ঘদিন তিনি ঢাকায় ‘আনন্দলোক’ নামের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতেন, যেখানে তিনি ছিলেন অধ্যক্ষ।
চট্টগ্রামের সংস্কৃতিকর্মীদের আড্ডাস্থল চেরাগী পাহাড়ে নিয়মিত মুখ ছিলেন নিজাম উদ্দিন। শিল্পপতি নুরুল আলমের একমাত্র পুত্র সন্তান নিজাম কিছুটা খেয়ালি ব্যক্তিত্বের মানুষ, ভ্রমণপাগলও ছিলেন। ব্যক্তিজীবনে সম্পর্কের কোন নির্দিষ্ট বা প্রথাগত সুতায় নিজেকে বাঁধেননি। চট্টগ্রামের সকল সাংস্কৃতিক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলনে সোচ্চার ছিলেন তিনি।
চট্টগ্রামের আলোকচিত্রশিল্পী কমল রুদ্র সদ্য প্রয়াত নিজামের বোহেমিয়ান জীবনকে দোষারোপ করে ফেসবুকে লিখেছেন- ‘তোকে কতোবার বলেছি জীবন নিয়ে খেলিস না বড় ভাইয়ের কথা শুনলি না ! এতো মেধা এতো পড়াশুনা তোর। কতো স্মৃতি দিনের পর দিন রাতের পর রাত। কতো স্বপ্ন কতো কিছু করবো দেশে। গান, গল্প , সিনেমা, কবিতা আহা হাত শক্ত হয়ে আসছে। কতো অভিমান তোর বকেছি তোকে। এইযে ছবি সিলেটের হাকালুকিতে তুলে দিয়েছিলাম বকুনি দেওয়ার পর তবুও হাসছিলি। কতো ভ্রমণের স্মৃতি আজ জড়ো হয়েছে কান্না ভেজা চোখে । জীবন এতো ছোট কেনে!’
চেরাগী আড্ডা ফেসবুক গ্রুপের শাহরিয়ার পারভেজ লিখেছেন- ‘শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি জানাই আমাদের আন্তরিক সমবেদনা’। কবি ও চবির প্রাক্তন শিক্ষার্থী রুদ্র অনির্বান ফেসবুকে লিখেছেন ‘সেই চেরাগিপাহাড়, রহমতগঞ্জ, জামালখান, চবি থেকে শাহবাগ, ধানমন্ডি, মগবাজার…কত রাতদিনের বন্ধু নিজাম; এ কী শুনলাম, বন্ধু!’ চলচ্চিত্র পরিচালক অঞ্জন সরকার জিমি ফেসবুকে লিখেছেন- ‘নিজাম, ভালো থেকো। অনেক স্মৃতি জমা রইলো’।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাজীব নন্দী ফেসবুকে লিখেছেন- ‘নিজাম ভাইয়ের ছিলো ঘরভর্তি বই, ছিলো মনভর্তি ফুর্তি, হার্ডডিস্ক ভর্তি সিনেমা আর বুকভর্তি স্বপ্ন। অত্যন্ত সংবেদনশীল একজন মানুষ। স্বপ্ন দেখেছিলেন সমাজতান্ত্রিক, শোষণহীন ও বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশের। সেই পথে হেঁটেওছিলেন বহুদূর। পারিবারিক প্রাচুর্য, বিত্ত আর বৈভব থেকে সন্তর্পনে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। কী অমায়িক আর অসম্ভব আড্ডাবাজ একজন মানুষ। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় গিয়েছিলেন থাকতে। কিন্তু, মহাকালের উর্ধ্বরথ যাকে টেনেছে, তাঁকে কি আর ধরে রাখা যায়’?
চট্টগ্রামের আড্ডাপাড়ায় নিজাম উদ্দিনের অকাল মৃত্যু সুহৃদ-শুভানুধ্যায়ীদের শোকে আবিষ্ট করে রেখেছে। এই শহরে নিজামের মতো অনেকেই বিপ্লবের মিছিল থেকে ছিটকে ব্যক্তিজীবনের টানাপড়নে লড়ছেন। নিজামের প্রস্থান যেন তাঁদের কানে ফিশফিশ স্বরে বলে যাচ্ছে- বিপ্লবের স্বপ্নটুকু ফিকে হচ্ছে, সাংস্কৃতিক জাগরণ ও বিকল্প শিল্পসাহিত্যের পথ ক্রমেই কুয়াশায় হারাচ্ছে, পুঁজির প্রবল প্রতাপে সম্পর্কগুলোও পরিণত হচ্ছে স্বার্থে; তবুও এই কঠিন শহরে ফুসফুসের সকল দুয়ার খোলা অট্টহাসির ব্যতিক্রমী নিজাম ভাই কারো না কারো স্মৃতিতে অম্লান, অক্ষয় হিসেবে থাকবে আরো বহুকাল!