বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী দেশ ভারত। অর্থনীতি, চিকিৎসা, সংস্কৃতি, রাজনীতি সব অর্থে বাংলাদেশের স্বার্থের সাথে বন্ধুপ্রতীম এই দেশটি যুক্ত।
সেই ভারতে ঘনিয়ে এসেছে নির্বাচন। ভারতের জাতীয় নির্বাচনকে বলে লোকসভা নির্বাচন। প্রায় ৯০ কোটি ভোটার এবারের নির্বাচনে ভোট দেয়ার সুযোগ পাবেন এবং এজন্য ভোট কেন্দ্র থাকবে দশ লাখেরও বেশি। বলা বাহুল্য, ভারতের ভোটার সংখ্যা যৌথভাবে ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়ার মোট জনসংখ্যারও বেশি। কিন্তু ৯০ কোটি ভোটারদের শারীরিক উপস্থিতির চাইতেও গুরুত্বের সাথে ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে শত কোটি সোশ্যাল মিডিয়ার একাউন্ট। ৯০ কোটি ভোটারের দেশে মাথাব্যথা এখন টুইটার, ফেসবুক ও হোয়াটসএপের একাউন্ট! পাড়ার মোড়ের দাদু থেকে শুরু করে প্রতাপশালী নরেন্দ্র মোদি, সবাই আছেন এই সামাজিক ভার্চুয়াল জালে, সমানতালে।
প্রসঙ্গত, সংসদীয় গণতন্ত্রের হিসাবে ভারত পৃথিবীর বৃহত্তম৷ অন্যান্য দেশের তুলনায় ভারতে প্রাপ্তবয়স্ক ভোটারের সংখ্যা অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে বেশি৷
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নির্বাচনের খরচের হিসেবে ভারতের নির্বাচনের খরচই সবচেয়ে বেশি। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের চেয়েও তা এক বিলিয়ন বেশি হবে বলে গণমাধ্যমের খবরে প্রকাশ। এবারের লোকসভা নির্বাচনেই খরচ হতে চলেছে প্রায় ৫০ হাজার কোটি রুপি। নয়াদিল্লির সেন্টার ফর মিডিয়া স্টাডিজের (সিএমএস) তথ্য মতে, ২০০৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্টের নির্বাচনে সাড়ে ছয় বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছিল। কিন্তু ভারতের ভোটে এ বার খরচ হতে চলেছে প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার। নির্বাচন কমিশন এবছর সোস্যাল মিডিয়ার বিজ্ঞাপন বাবদ যে খরচ হবে তাকেও প্রার্থীর খরচের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সোশ্যাল মিডিয়ার হেড অফিসগুলোর ঘুম উবে গেছে এই নির্বাচনে। ভারত থেকে বহু দূরে থেকেও তাদেরকে এখন ভারতকেই অনেক বেশি গুরুত্ব দিতে হচ্ছে। কারণ বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম জনসংখ্যার এ দেশটি ফেসবুকেরও সবচেয়ে বড় বাজার। ফেসবুকের মেসেজিং অ্যাপ হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহারকারীও এ দেশে সবচেয়ে বেশি। এছাড়া মাইক্রো ব্লগিং সাইট টুইটারেরও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ব্যবহারকারী ভারতীয়। ফলে আগামী ১১ এপ্রিল থেকে অনুষ্ঠেয় ভারতের জাতীয় নির্বাচন হবে এ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর জন্য সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা। এ নির্বাচন ঘিরে শঙ্কার আরো বড় একটি কারণ হতে পারে ভোটগ্রহণের সময়। প্রায় পাঁচ সপ্তাহজুড়ে ধাপে ধাপে অনুষ্ঠিত হবে ভোটগ্রহণ। এত দীর্ঘ সময়ের মধ্যে ভোটারদের নানাভাবে প্রভাবিত বা বিপথগামী করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে সে দেশের নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের ভাবনা।
কারণ এর আগে দুই মাস সময়কালে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ছেলে ধরা সন্দেহে ২৭ জনকে গণপিটুনি দেওয়ার মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে৷ সেই পিটুনিতে মারা গেছে ২২জন৷ ভারতের গণমাধ্যম নিয়মিত দেখলে খেয়াল করা যায়, সোস্যাল মিডিয়াতে শিশু পাচারের গুজব ছড়িয়েই এ সব ঘটানো হয়। শিশু পাচারকারী বা ছেলে ধরা সন্দেহে পিটিয়ে মারার ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে৷ নেপথ্যর ঘাতক সোশ্যাল মিডিয়ার গুজব। ফলে সেই সোশ্যাল মিডিয়াকে নিয়েই ভাবতে হলো ভারতকে। নির্বাচনী আচরণবিধি চালু হলো। নির্বাচন কমিশনের সাথে আলোচনা করে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলি স্বেচ্ছায় বিধি নির্মাণ করেছে। হোয়াটসঅ্যাপে এক বারে কত জনকে বার্তা পাঠানো যাবে, তার সীমারেখা টেনে দেওয়া হলো।
নির্বাচনের আটচল্লিশ ঘণ্টা পূর্বে রাজনৈতিক প্রচারও থামবে সোশ্যাল মিডিয়ায়। আর বিধি লঙ্ঘন করলে তিন ঘণ্টার মধ্যে ব্যবস্থা নিবে সংস্থাগুলি।
মোট নব্বই কোটি ভোটারের দেশে তাই সোশ্যাল মিডিয়া একটি বিরাট মাথাব্যথা। নির্বাচন মানে ভোটারদের শারীরিক উপস্থিতি- এতদিন এটাই জানতাম। কিন্তু ভোটের উত্তাপ এখন চলে এসেছে মোবাইল থেকে মোবাইলে। রাজনৈতিক কর্মীরা ব্যানার ফেস্টুন ছেড়ে ট্রল-বাহিনীতে পরিণত হয়েছে।
রামায়নে রামের লঙ্কা অভিযানে এক যোদ্ধার নাম শোনা যায়, মেঘনাদ। মেঘনাদ ছিলেন রাবণের পুত্র। মেঘের আড়াল থেকে ঘোরতর যুদ্ধ করতেন বলে তাঁর নাম হয় মেঘনাদ। মেঘনাদ রাম ও রাবণের মধ্যে সংঘটিত লঙ্কার যুদ্ধে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। দেখা যাক, দিল্লি দখলের যুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার কোথায় গিয়ে ঠেকে। সোশ্যাল মিডিয়া কি মেঘনাদের মতো ভোটকেন্দ্রের আড়াল থেকে ভার্চুয়াল আগুন ছড়াতে যাচ্ছে?