বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া জেলে রয়েছেন এবং দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা তারেক রহমান দেশে ফিরতে পারছেন না। দলের নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা টানাপোড়নে সংসদে গেলেও মহাসচিব মির্জা ফখরুল যাননি। পেট্রোল বোমার দায়, দশ ট্রাক অস্ত্র ইস্যুতে ভারতের ইতিবাচকতা থেকে ছিটকে পরা, আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা মামলা, সাংগঠনিক দুর্বলতা, যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গ; এসবকিছু ঘরে-বাইরে গৃহদাহ করছে বিএনপির।
প্রায় এক দশক ধরে কঠিন চ্যালেঞ্জের বেড়াজালে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া দলটি। দীর্ঘদিন নির্বাচনি রাজনীতির বাইরে থাকা এ দলটি এবার আরও চাপে পড়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। জন্মের পর থেকে দলটি এত দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকেনি। সরকারের কঠোর আচরণের মুখে বিএনপি রাজপথে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারছে না। দলটির সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা সফল হয়েছে, সেটাও বলা যায় না।
ওয়ান-ইলেভেনের ধাক্কা সামলিয়ে ও নানাভাবে সাংগঠনিক বিপর্যয় কাটিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে দলটি। বিগত আন্দোলন সামলে নির্বাচনি মাঠে সক্রিয় হতে নানামুখী তৎপরতাও চালায় তারা। কিন্তু বিরোধীদল বিএনপির ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে নেতৃত্বের সিদ্ধান্তহীনতা একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে দলটির তৃণমূলের নেতাদের ধারণা।
তারা বলেছেন, সিদ্ধান্তহীনতার পেছনে নেতাদের মধ্যে বিশ্বাসের ঘাটতি এবং অগ্রাধিকার বা সমস্যা চিহ্নিত করতে না পারাসহ বেশ কিছু বিষয় রযেছে। দলটির তৃণমূলের নেতারা সংসদে যোগ দেওয়া নিয়ে শেষ মুহূর্তে তাদের দলের সিদ্ধান্ত আকস্মিকভাবে বদলের বিষয়কে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেছেন। গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখান করে বিএনপি সংসদে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত শেষ মুহূর্তে পাল্টিয়ে সংসদে গেছে বিএনপি।
এদিকে ৬ মে বিএনপির দীর্ঘদিনের শরিক বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ ২০ দলীয় জোট থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ লেবার পার্টিও হুমকি দিয়েছে জোট ছাড়ার। সবমিলিয়ে একপ্রকার কোণঠাসায় বিএনপি।
এখন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নির্বাচনের পরেই তাৎক্ষণিকভাবে সংসদে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়তো সঠিক ছিল না। এবারের পরাজয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে নেতৃত্বশূন্য হিসেবে দেখছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। ভোটের মাঠে নেতাদের না পেয়ে কর্মী-সমর্থক ও ভোটাররা হতাশ ও ক্ষুদ্ধ হন। প্রার্থী ও সিনিয়র নেতারা বারবার নেতাকর্মী-সমর্থক ও ভোটারদের মাঠে নামার নির্দেশ দিলেও তারাই মাঠে নামেননি। সবার প্রত্যাশা ছিল অন্তত ভোটের দিন নেতারা মাঠে নামবেন।
সিদ্ধান্ত প্রণয়নে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা সর্বনাশ ডেকে এনেছে বলে মনে করছে বিএনপির একটি অংশ। তাদের অভিযোগ, বিএনপি জনমতহীন কয়েকজন নেতার পেটে ঢুকে পড়েছে, যা থেকে বের হতে পারেনি।
দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারারুদ্ধ হওয়ার পর আবারও ‘কঠিন পরীক্ষায়’ পড়েছে বিএনপি। আইনি লড়াই, শীর্ষ নেতৃত্বের শূন্যতা, খালেদা জিয়ার নির্বাচনে অংশগ্রহণ, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের ব্যাপারে সমঝোতা না হওয়া, দল হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারা না পারা, দলের ভাঙনরোধ এবং ঐক্য ধরে রাখার মতো কঠিন চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে হবে দলটিকে।
অন্যদিকে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল নেতাদের সামনে হাজার হাজার মামলার খড়গ। মামলার ভারে ন্যুব্জ অনেক নেতাকর্মী। রয়েছে হুমকি-ধমকি, এমনকি দল ছাড়ার চাপ। সব মিলিয়ে চার দশকের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে বিএনপি।
৩০শে ডিসেম্বরের নির্বাচনে অংশ নেওয়া না নেওয়া প্রশ্নে বিএনপিতে প্রথমে সিদ্ধান্তহীনতা ছিল। মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা এমন ধারণা পেয়েছিলেন। শেষপর্যন্ত ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট যখন গঠন করা হয়, তখন বিএনপির নেতাকর্মীরা ঐফ্রন্টকে তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর একটা প্লাটফর্ম হিসেবে দেখেছিলেন। কিন্তু নির্বাচনে বিপর্যয়ের পর সেই ফ্রন্ট নিয়েই বিএনপিতে বিতর্ক দেখা দেয়।
বিএনপির অনেকে বলেছেন, বিএনপি ঐক্যফ্রন্টে যাওয়াটা ছিল বিষপানের মতো। ঐক্যফ্রন্টের কারণে ড. কামাল হোসেনের দল গণফোরামের লাভ হলেও বিএনপির ভরাডুবি হয়েছে বলে দলের মধ্যে প্রচলন রয়েছে। এ নিয়ে বিএনপির মধ্যে দুইটি গ্রুপও সৃষ্টি হয়েছিল।
কঠিন সংকটের চোরাবালিতে বিএনপি। এই সংকটে থেকে উত্তরণের পথ খুঁজছে এতোদিনকার রাজপথের বিরোধী দলটি। বিএনপির বোদ্ধারা মনে করছেন, প্রতিষ্ঠার পর বিএনপিকে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে, হাঁটতে হয়েছে কণ্টকাকীর্ণ পথের বাঁকে বাঁকে। তবে এবারের মতো সংকটের এতোটা দীর্ঘপথ হাঁটতে হয়নি কোনো সময়েই।