ত্রিদেশীয় সিরিজে ক্যারিবীয়দের নিজেদের প্রথম ম্যাচে পাত্তাই দিল না বাংলাদেশ। বোলিং, ব্যাটিং কিংবা ফিল্ডিং- তিন বিভাগেই হোল্ডার-হোপদের উড়িয়ে দিয়ে ত্রিদেশীয় সিরিজে উড়ন্ত সূচনা করলেন মাশরাফি-তামিম-সাকিবরা।
এদিন প্রথমে বল হাতে গুরুত্বপূর্ণ ৩ উইকেট নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের ২৬১ রানেই আটকে রাখার কাজটা ভালোভাবেই করেছিলেন অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা। পরে ব্যাট হাতে রান তাড়ার কাজটি সহজ হয়েছে প্রথম সারির তিন ব্যাটসম্যান তামিম ইকবাল, সৌম্য সরকার এবং সাকিব আল হাসানের ফিফটির বদৌলতে। মাত্র ২ উইকেট হারিয়ে ৩০ বল হাতে রেখেই লক্ষ্যে পৌঁছে গেছে বাংলাদেশ।
২৬২ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে শুরুটা বেশ সাবধানী করেছিলেন তামিম এবং সৌম্য। তবে শুরু থেকেই চালিয়ে খেলার আভাস দিয়ে রেখেছিলেন সৌম্য। ইনিংসের তৃতীয় ওভারের প্রথম বলে বাউন্ডারির খাতা খোলেন তিনি। আবার পঞ্চম ওভারের প্রথম বলেই দ্বিতীয় বাউন্ডারিটিও মারেন তিনি।
তবু তামিমের অতিরিক্ত সাবধানী ব্যাটিংয়ে প্রথম ১০ ওভারে ৩৮ রানের বেশি করতে পারেনি বাংলাদেশ। ইনিংসের দশম ওভারের পরপর দুই বাউন্ডারি হাঁকানোর মাধ্যমে নিজের বাউন্ডারির খাতা খোলেন তামিম।
প্রথম পাওয়ার প্লে’র পর খানিক হাত খুলে খেলতে শুরু করেন দুজনই। তবে বাউন্ডারির চেয়ে ১-২ নিয়ে খেলার দিকে মনোযোগী হন তামিম। অন্যদিকে সৌম্য খেলতে শুরু করেন নিজের সাবলীল ভঙ্গিতে, বোলারদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে।
ইনিংসের ১২তম ওভারে ক্যারিবীয় অধিনায়ক জেসন হোল্ডারকে প্রথম ছক্কা মারেন সৌম্য। ১৮তম ওভারের শেষ বলে হোল্ডারকেই বাউন্ডারি হাঁকানোর মাধ্যমে নিজের অষ্টম হাফসেঞ্চুরি পূরণ করেন তিনি। এ মাইলফলকে পৌঁছতে ৪৭ বলে ৭ চার এবং ১টি ছক্কা হাঁকান সৌম্য।
খানিক পরই সৌম্যর দেখাদেখি নিজের ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ৪৫তম ফিফটি তুলে নেন তামিম। রয়েসয়ে খেলা তামিম ৭৮ বলে ৫ চারের মারে এ মাইলফলকের পৌঁছান। মনে হচ্ছিলো তামিম-সৌম্যের জুটিতেই হয়তো ইতিহাস গড়ে ফেলবে বাংলাদেশ।
কিন্তু ২৬তম ওভারের শেষ বলে রস্টোন চেজকে সরাসরি বাউন্ডারি ওপারে ফেলতে গিয়ে ড্যারেন ব্রাভোর হাতে ক্যাচে পরিণত হন সৌম্য। থেমে যায় তার ৬৭ বলে খেলা ৭৩ রানের ঝলমলে ইনিংস। ৯ চার এবং ১ ছয়ের মারে ইনিংসটি সাজান তিনি।
সৌম্য ফিরে গেলে দ্বিতীয় উইকেটে ৫২ রানের দারুণ জুটি গড়েন দুই বন্ধু সাকিব আল হাসান এবং তামিম ইকবাল। দায়িত্বশীল তামিমের ব্যাট থেকে সেঞ্চুরির আশায় ছিলেন সবাই। কিন্তু দলীয় ১৯৬ রানের মাথায় ব্যক্তিগত ৮০ রানে হোল্ডারের দারুণ ক্যাচে সাজঘরে ফিরে যান তামিম। প্রায় আড়াই ঘণ্টার ইনিংসে ৭টি চার মারেন তিনি।
দুই ওপেনারের উইকেট নিলেও ম্যাচে ফেরা হয়নি ওয়েস্ট ইন্ডিজের। উল্টো তৃতীয় উইকেটে জুটি গড়ে বাংলাদেশকে লক্ষ্যে পৌঁছে দেন সাকিব আল হাসান এবং মুশফিকুর রহীম। সাকিব তুলে নেন ক্যারিয়ারের ৪১তম হাফসেঞ্চুরি, খেলতে থাকেন বলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে।
অন্যদিকে ইনিংসের ৪৫তম ওভারে মুশফিকও জোড়া ছক্কা হাঁকিয়ে দলকে পৌঁছে দেন জয়ের দোরগোড়ায়। তবে উইনিং শটটা নেন সাকিবই। সে ওভারেরই শেষ বলে চার মেরে ম্যাচ জেতান সাকিব। ৬১ বলে ৬১ রান করে অপরাজিত থাকেন তিনি। মুশফিকের ব্যাট থেকে আসে ২৫ বলে ৩২ রানের ইনিংস।
এর আগে টসে জিতে ব্যাট করতে নেমে উদ্বোধনী জুটিতে রীতিমতো টাইগার বোলারদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ম্যাচের প্রথম ঘণ্টায় ১৬ ওভারে কোনো উইকেট না হারিয়ে ৮৫ রান তুলে নেয় ক্যারিবীয়রা।
তবে তাদের ব্যাটিংয়ের শুরুটা এতোটা সহজ ছিল না। ইনিংসের প্রথম বলেই চার হাঁকালেও দুই ডান হাতি পেসার মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন এবং মাশরাফি বিন মর্তুজার মাপা লাইন-লেন্থের বিরুদ্ধে শুরুর দিকে ধুঁকতে হয়েছে হোপ-অ্যামব্রিসকে।
ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারের প্রথম দুই বলেই অ্যামব্রিসের বিপক্ষে লেগ বিফোরের শক্ত আবেদন করেন টাইগার অধিনায়ক মাশরাফি। কিন্তু আম্পায়ার নাকচ করে দেন সে আবেদন। প্রথম ১০ ওভারে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সংগ্রহ দাঁড়ায় বিনা উইকেটে ৪৮ রান।
১১তম ওভারে প্রথমবারের মতো মোস্তাফিজুর রহমান আক্রমণে এলে হাত খুলে খেলার সুযোগ পান দুই ক্যারিবীয় ওপেনার। তবে বাঁ হাতি স্পিনার সাকিব আল হাসান সাধ্যমতো চেষ্টা করেন রানের চাকা আটকে রাখার। সাকিবের এ প্রচেষ্টার সুফল ভোগ করেন মেহেদি হাসান মিরাজ।
উদ্বোধনী জুটিতে দুই ওপেনার ১৬ ওভার খেলে যোগ করেন ৮৫ রান। ১৭তম ওভারে আক্রমণে আসেন মিরাজ। আক্রমণে আসার পর প্রথম বলেই বাউন্ডারি মেরে তাকে স্বাগত জানান অ্যামব্রিস। তবে পরের বলেই অ্যামব্রিসকে শর্ট কভারে থাকা মাহমুদউল্লাহর হাতে ক্যাচ বানিয়ে প্রতিশোধ নিয়ে নেন মিরাজ।
ঠিক পরের ওভারেই ড্যারেন ব্রাভোকে উইকেটের পেছনে ক্যাচে পরিণত করেন সাকিব আল হাসান। আউট হওয়ার আগে ৪টি বাউন্ডারি মেরে ৫০ বলে ৩৮ রান করেছেন অ্যামব্রিস। ব্রাভো আউট হয়েছেন ৪ বলে মাত্র ১ রান করে।
পরপর দুই উইকেট পড়লেও তৃতীয় উইকেটে রস্টোন চেজকে নিয়ে ফের লম্বা জুটি গড়েন শাই হোপ। আড়াই বছরের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ২০০০ রানের মাইলফলকে পৌঁছতে ৫৩ রানের প্রয়োজন ছিলো শাই হোপের। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ১৭০ রানের ইনিংস খেলায় আজ (মঙ্গলবার) বাংলাদেশের বিপক্ষেও আত্মবিশ্বাসী ছিলেন তিনি।
ধারাবাহিকতা বজায় রেখে টাইগারদের বিপক্ষে টানা তৃতীয় ম্যাচে পঞ্চাশোর্ধ ইনিংস খেলার পাশাপাশি ওয়েস্ট ইন্ডিজের ২১তম ব্যাটসম্যান হিসেবে ক্যারিয়ারের দুই হাজার রানও পূরণ করে ফেলেছেন হোপ। একইসঙ্গে ভেঙে দিয়েছেন দুই সাবেক ক্যারিবীয় তারকা স্যার ভিভ রিচার্ডস এবং ব্রায়ান লারার রেকর্ড।
দেখেশুনে খেলে হোপ ১২৬ বলে ১০ চার ও ১ ছয়ের মারে পূরণ করেছেন নিজের ক্যারিয়ারের ষষ্ঠ সেঞ্চুরি। এছাড়া আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম ম্যাচে হোপের ব্যাট থেকে এসেছে ১৭০ রানের ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস।
তবে সেঞ্চুরির পর বেশিদূর যাওয়া হয়নি হোপের। মাশরাফি বিন মর্তুজার দুর্দান্ত শেষ স্পেলে কক্ষচ্যুত হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তৃতীয় উইকেট জুটিতে যেখানে ৩০০ ছুঁইছুঁই সংগ্রহ উঁকি দিচ্ছিল, সেখানে মাশরাফির দারুণ বোলিংয়ে পরপর তিন উইকেট হারিয়ে ফেলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
ইনিংসের ৪১তম ওভারে প্রথম ৫১ রান করা চেজকে ফেরান মাশরাফি। বড় শট খেলতে গিয়ে হাওয়ায় ভাসিয়ে মুশফিকের হাতে ক্যাচ দেন চেজ। নিজের পরের ওভারের প্রথম বলেই সেঞ্চুরিয়ান হোপকে মোহাম্মদ মিঠুনের হাতে ক্যাচে পরিণত করেন টাইগার অধিনায়ক।
আউট হওয়ার আগে ১১ চার এবং ১ ছক্কার মারে ১৩২ বলে ১০৯ রান করেন হোপ। উইকেটে আসেন ক্যারিবীয় অধিনায়ক জেসন হোল্ডার। মাশরাফির প্রথম বলেই চার হাঁকান তিনি। তবে পরের বলেই তাকে উইকেটের পেছনে ক্যাচে পরিণত করেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। ২ উইকেটে ২০৫ থেকে ৫ উইকেটে ২১১ রানের দলের পরিণত হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
ইনিংসের ৪৫তম ওভারে উইকেট শিকারের উৎসবে যোগ দেন সাইফউদ্দিন, ফিরিয়ে দেন অভিষিক্ত শেন ডাওরিচকে। তবু মোস্তাফিজের লাইন-লেন্থহীন বোলিংয়ের ফায়দা নিয়ে রান করতে থাকেন অ্যাশলে নার্শ এবং জোনাথন কার্টার। ৪৮তম ওভারে ৭ উইকেটে ২৫০ পূরণ হয় তাদের।
শেষ দুই ওভারে আরও ১১ রান নিয়ে দলীয় সংগ্রহটাকে ২৬১ রানে নিয়ে ঠেকায় ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানরা। বাংলাদেশের পক্ষে মাশরাফির ৩ উইকেট ছাড়াও ২টি করে উইকেট নেন সাইফউদ্দিন এবং মোস্তাফিজ। দুই স্পিনার মিরাজ ও সাকিব নেন ১টি করে উইকেট।