উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) পরীক্ষা শেষ হতে না হতেই বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিংয়ের লোভনীয় বিজ্ঞাপন আর বিলবোর্ডে ছেয়ে যায় পরীক্ষাকেন্দ্রের আশপাশ এবং নগরের বিভিন্ন এলাকা। অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে তাদের মূল অবলম্বন হচ্ছে চটকদার বিজ্ঞাপন ও প্রচারপত্র। থাকে অনেক দায়িত্ব পালনের অঙ্গীকারও। কোটি টাকার ব্যবসা বলে কথা।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ম সারিতে চান্স পাওয়া মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিজেদের দাবি করা এবং লোভনীয় অফার দিয়ে লিফলেট ছাপানো কোচিং সেন্টারগুলোর পুরানো ঐতিহ্য। সম্প্রতি প্রতিযোগিতার এই বাজারে টিকে থাকতে লোভনীয় বিজ্ঞাপনের সঙ্গে রাজনৈতিক ইস্যুকে হাতিয়ার করছেন কোচিং সেন্টারের মালিকরা। এমন অভিযোগ খোদ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের। আর মালিকদের এই রেষারেষিতে বিপাকে পড়েছে প্রাইম নামের একটি কোচিং সেন্টারে ভর্তি হওয়া চট্টগ্রামের হাজারো শিক্ষার্থী।
নগরের চকবাজারে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং প্রাইম এর পরিচালক শাহাদাতের বিরুদ্ধে সরকার ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তিমূলক কয়েকটি পোস্ট ও মন্তব্য ফেইসবুকে বিভিন্ন পেইজ থেকে ভাইরাল হয়। ভাইরাল হওয়া পোস্ট আর মন্তব্যের বরাত দেওয়া হয়েছে প্রাইম কোচিংয়ের। আর এ সূত্র ধরে শাহাদাতকে গত ১৬ মে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর মধ্যে শাহাদাতসহ দুইজন পরিচালককে বাদ দিয়ে নতুনভাবে ক্লাস শুরু করেছে প্রাইম। প্রাইমের কর্মকর্তারা বলছেন, শাহাদাতের ব্যক্তিগত বিষয় প্রাইম নেবে না।
ঝাউতলার বাসিন্দা শামসুল ইসলাম একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করেন। তিনি জয়নিউজকে বলেন, আমার বড়ছেলের স্বপ্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। ধার-দেনা করে ৭০০০ টাকা দিয়ে প্রাইম কোচিংয়ে ভর্তি করিয়েছি। কিন্ত দুইদিন ক্লাস করে ছেলে বাসায় এসে জানালো, কোচিং সেন্টার নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে। কোচিং বন্ধ। খবর নিয়ে জানলাম রাজনৈতিক ঝামেলা। সোমবার ছেলে এসে জানায়, ক্লাস আবার শুরু হয়েছে। কিন্ত আমি নিরাপত্তার কারণে ছেলেকে পাঠাতে ভয় পাচ্ছি। কোচিং সেন্টারগুলো রাজনীতিকে ইস্যু করে ছেলেদের ক্ষতি করবে, এটা দুঃখজনক।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, আমরা দুইদিন মাত্র ক্লাস করেছি। শাহাদাত ভাই নামে কাউকে চিনি না, তাঁর ক্লাসও পাইনি। কিন্ত উনার রাজনৈতিক স্ট্যাটাস নিয়ে যে সমস্যা, তার ফলভোগ করছি আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা। আমরা শিবির বা ছাত্রলীগ এর দায় নিতে আসিনি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে এখানে পড়তে এসেছি।
প্রাইম কোচিং এর জিইসি শাখার কোর্স কো-অর্ডিনেটর নুরুল আবছার জয়নিউজকে বলেন, ফেইসবুকে পরিচালকদের স্ট্যাটাস ও মন্তব্যকে কেন্দ্র করে আমাদের চকবাজার শাখা কিছুদিন বন্ধ ছিল। পরে হালিশহর শাখার নোমান ভাইকে পুলিশ নিয়ে গেলে ওই শাখাও সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়। আমি প্রাইমে বেতনভুক্ত কর্মকর্তা। নিরাপত্তাজনিত কারণে আমিও বাধ্য হই জিইসি শাখা বন্ধ রাখতে। তবে ডিরেক্টরদের আলোচনার মাধ্যমে সোমবার সব শাখায় ক্লাস চালু করেছি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইউসিসি ও প্রাইম দীর্ঘদিন যাবৎ নিজেদের ব্যবসা পোক্ত করতে ফেইসবুকসহ বিভিন্ন জায়গায় কাঁদা ছোঁড়াছুঁড়ি করে আসছিল। কখনও মেধাবীদের নিজেদের দাবি করে, কখনও কোচিংয়ের মান নিয়ে, আবার কখনও রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়েও। সর্বশেষ প্রাইম মালিক শাহাদাতের ২০১৩ সালের ফেইসবুক স্ট্যাটাস ভাইরাল করে প্রাইমের বিরুদ্ধে প্রচারের ঘটনায় অভিভাবক, শিক্ষার্থী ও প্রাইম কর্তৃপক্ষ দোষ চাপাচ্ছে ইউসিসি’র ঘাড়ে।
প্রাইম কর্তৃপক্ষের দাবি, উদ্যেশ্যপ্রণোদিত হয়ে প্রাইম প্রতিষ্ঠার আগে ফেইসবুকে দেওয়া দুইজন পরিচালকের ব্যক্তিগত স্ট্যাটাস ভাইরাল করে প্রতিষ্ঠানের ঘাড়ে দায় চাপাচ্ছে ইউসিসি কর্তৃপক্ষ।
তারা বলেন, বিগত বছরগুলোর সাফ্যল্যের ধারাবাহিকতায় শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রাইম আস্থা কুড়িয়েছে। এ ধারাবাহিকতায় এই বছরও অধিকাংশ শিক্ষার্থী এখানে ভর্তি হয়েছে, যা একটি কুচক্রিমহলের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রাইমের একজন সিনিয়র শিক্ষক জয়নিউজকে বলেছেন, মানলাম শাহাদাত শিবির করেছেন। স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। কিন্ত এটা এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হতে না হতেই বুস্ট করে অনলাইনে প্রচার, কিসের ইঙ্গিত দেয়! অবশ্যই কারো কোচিং ব্যবসা খারাপ যাচ্ছে দেখে তারা ব্যক্তি শাহাদাতকে ঢাল বানিয়ে প্রাইমের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাচ্ছে। শাহাদাতের অপরাধের দায়ভার প্রাইম কোচিং কেন নেবে? প্রাইম তার একার প্রতিষ্ঠান না। এখানে আরো ক’জন পরিচালক আছেন। প্রাইমের বিরুদ্ধে এ প্রচারণা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং ইউসিসি এটা করছে, সবাই জানে।
তবে এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে ইউসিসি’র একাধিক কর্মকর্তা বলেন, প্রাইম কোচিং শিবির সম্পৃক্ততার দায় এড়াতে ইউসিসিকে অনর্থক দোষারোপ করছে।
ইউসিসি চট্টগ্রামের প্রধান ও চট্টগ্রাম কোচিং এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সোহেল জয়নিউজকে বলেন, কেউ দোষ চাপালে তো হবে না। আমরা ২০০৩ সাল থেকে চট্রগ্রামে সাফল্যের সঙ্গে কোচিং পরিচালনা করছি। কিন্তু কারো বিরুদ্ধে প্রচার-প্রচারণা কখনো করিনি। বরং আমাদের বিরুদ্ধে ফেইসবুকসহ বিভিন্ন জায়গায় প্রচারণা চালিয়েছে অনেকে। আর প্রাইম পরিচালকরা ইউসিসি নিয়ে অনেক মন্তব্য করেছেন। সরকার যখন প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে সব কোচিং বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন আমরা কোচিং এসোসিয়েশন করে যারা প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রদ্রোহী কাজে সম্পৃক্ত তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিই। তখন প্রাইমসহ অনেক সংগঠন আমাদের এসোসিয়েশনে যুক্ত হয়নি। তাই আমরা এসোসিয়েশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ৪০টি কোচিং মিলে এক লিফলেটে এ ধরনের কোচিং সেন্টারে ভর্তি না হওয়ার প্রচারণা চালাই। তবে প্রাইম বা নির্দিষ্ট কোনো কোচিং সেন্টার নিয়ে আমরা কোনো প্রচারণা করিনি।
চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নিজাম উদ্দিন জয়নিউজকে বলেন, প্রাইম কোচিং এর পরিচালক শাহাদাতকে ডিজিটাল নিরপত্তা মামলায় আটক করা হয়েছে। আমরা গোপনসূত্রে সংবাদ পেয়ে তাকে আটক করি। স্ট্যাটাস ও মন্তব্য তার আইডি থেকে করা হয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখতে আমরা ঢাকায় আইটি এক্সপার্টদের কাছে পাঠাচ্ছি।
জয়নিউজ/আরসি