একাত্তরে নির্যাতিত হয়েছেন পাক হানাদার বাহিনীর হাতে। স্বাধীন বাংলাদেশে হারিয়েছেন তিন সন্তান। দারিদ্র্যতার সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন আজীবন। কিন্তু নীতি-আদর্শে সর্বদাই ছিলেন অবিচল। একাত্তরের সেই মুক্তিযোদ্ধা বীরাঙ্গনা রমা চৌধুরীর বিদায়টাও হয়েছে বীরের মতোই।
সোমবার ভোরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৃথিবীকে বিদায় জানিয়েছেন রমা চৌধুরী। তাঁর মৃত্যুতে চট্টগ্রামজুড়ে বইছে শোক। চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্তরের মানুষ রমা চৌধুরীর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন।
রমা চৌধুরীকে নিয়ে বলতে গিয়ে শহীদ জায়া বেগম মুশতারি শফি বলেন, মুক্তিযোদ্ধা রমা চৌধুরী জীবনের সর্বস্ব হারিয়েছেন দেশের জন্য। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি স্বীকার করেছেন ত্যাগ। দেশ মাতৃকার জন্য তার মতো ত্যাগের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপনকারীর সংখ্যা খুবই নগণ্য। আজ তিনি নেই। তার স্মৃতিগুলো আমাদের সাহসের সাথে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা। রমা চৌধুরীর জীবনকর্ম ও স্মৃতি সংরক্ষণ করতে আমরা সরকারের কাছে আবেদন জানাই।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র চৌধুরী হাসান মাহমুদ হাসনী বলেন, রমা চৌধুরী ছিলেন আমাদের দেশপ্রেমের অনুপ্রেরণা। অসুস্থতার সময়ে মেয়র মহোদয় হজ করতে গেলেও সার্বক্ষণিক খোঁজ রেখেছেন রমা চৌধুরীর। তার নির্দেশে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে রমা চৌধুরী সুচিকিৎসা নিশ্চিতের সবগুলো বিষয় মনিটর করা হয়েছে।
রমা চৌধুরীর মৃত্যুতে শোক জানিয়ে চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি নাজিম উদ্দিন শ্যামল বলেন, মুক্তিযুদ্ধে পাকহানাদারদের নির্যাতনের বিভৎসতা তিনি বয়ে বেড়িয়েছেন ৪৭ বছর। দেশজুড়ে বিধ্বস্ততা জীবন্ত সাক্ষী ছিলেন রমা চৌধুরী। মুক্তিযোদ্ধারাসহ তার সন্তানরা যে মাটিতে শুয়ে আছেন সে মাটিতে জুতা পায়ে হাটেননি।
দুঃসময়ে রমা চৌধুরীর সন্তানের মতো পাশে থাকা আলাউদ্দীন খোকন জয়নিউজকে বলেন, মা সহজ সরল জীবন যাপন করতেন। তার ইচ্ছে ছিল একটি অনাথ আশ্রম প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু তার সে আশা পূরণ হয়নি।
তিনি আরো বলেন, কারো কাছ থেকে টাকা ধার নেওয়া মা পছন্দ করতেন না। আমরা তাকে দাহ দিতে চাই। কিন্তু তিনি দাহ করা পছন্দ করতেন না। তার ইচ্ছে অনুযায়ী তার বাড়িতেই তার সন্তানদের পাশে সমাহিত করা হবে। তিনি বই বিক্রি করে তার ছেলেদের সমাধি নির্মাণ করেছিলেন। সবাইকে গ্রামের দিকে টানতেন। তার একটি কবিতা আছে, ‘গ্রাম বাংলায় চল’। তৃতীয় সন্তান মারা যাওয়ার পর থেকে জুতা পড়া বন্ধ করে দেন তিনি। তাকে শহরে একটি বাসা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি সে বাসায় উঠেননি।
জামালখান ওয়ার্ড কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, রমা চৌধুরীর সাথে আমাদের আত্মার সম্পর্ক ছিল। আমি তার স্নেহ ধন্য ছিলাম। তিনি আমার নিয়মিত খোঁজ নিতেন। আমিও চেষ্টা করতাম খোঁজখবর রাখতে। অর্থ সহযোগিতাকে তিনি স্বাভাবিকভাবে নিতেন না। তাই প্রতি মাসে দশ হাজার টাকার তার প্রকাশিত বই কিনতাম। বই বিক্রি করেই তিনি জীবনযাপন করতেন।
আন্দরকিল্লা ওয়ার্ড কাউন্সিলন জওহর লাল হাজারী বলেন, খুব কাছ থেকে রমা চৌধুরীকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। দীর্ঘদিন আমার এলাকায় ছিলেন তিনি। সর্বস্তরের মানুষের মন জয় করেছেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অন্যতম ফেরিওয়ালা ছিলেন আমাদের রমা চৌধুরী।
চট্টগ্রাম গণজাগরণ মঞ্চের সমন্বয়ক শরীফ চৌহান বলেন, সারাজীবনই মুক্তির যুদ্ধ করে গেছেন রমা চৌধুরী। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার অন্যতম কারিগর ছিলেন আমাদের মাসি। গোটা শহরজুড়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফেরি করে বেড়ানো রমা চৌধুরীর প্রয়াণ আমাদের চট্টগ্রামের প্রগতিশীল আন্দোলনের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের বীরাঙ্গনা রমা চৌধুরীর মৃত্যুতে আমরা শোকাহত। জাতি আজ একজন মুক্তিযুদ্ধের সৈনিককে হারালো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রমা চৌধুরীর সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিতে চেয়েছিলেন। শেষ মুহূর্তে তার চিকিৎসার সার্বিক বিষয় প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে দেখভাল করা হয়েছিল।
শ্রদ্ধা নিবেদন করে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন, চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ, মহানগর আওয়ামী লীগ, ওয়ার্কার্স পার্টি, সিপিবি, বাসদ, উদীচী, প্রজন্ম ৭১, গণজাগরণ মঞ্চ, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও সাহিত্য কেন্দ্র, চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল মডেল হাই স্কুল, অপর্ণাচরণ সিটি কর্পোরেশন বালিকা বিদ্যালয়, কুসুম কুমারি সিটি কর্পোরেশন বালিকা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়।
প্রসঙ্গত, চমেক হাসপাতালে ভর্তি রমা চৌধুরীর পরিস্থিতির অবনতি হলে বিশেষ সম্পাদকীয় লেখেন জয়নিউজবিডিডটকম সম্পাদক অহীদ সিরাজ চৌধুরী। যার শিরোনাম ছিল, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, রমা চৌধুরীর এখন আপনাকে প্রয়োজন’।