সামনে বিশাল হাতি। আরো রয়েছে বিশাল হনুমানের প্রতিকৃতি। সুভদ্রা, জগন্নাথ আর বলরামের রথ মাঝামাঝি। পেছনে রয়েছে তরুণ-তরুণীদের রঙিন মিছিল। ট্রাকের উপর বাজছে নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র। বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে নাচছে ভক্তরা।
রাস্তার দু’পাশে রথকে একনজর দেখার আশায় উৎসুক ভক্তদের ভিড়। রথ থেকে তাদের উদ্দেশে ছুঁড়ে দেওয়া হচ্ছিল নানা ধরনের প্রসাদ। সেটি পেয়ে অনেকে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছেন অবস্থা।
বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) বিকেলে নগরে ইসকন আয়োজিত রথযাত্রার চিত্র এটি। নাচ-গানের তালে, বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা ও উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে নগরে পালিত হয়েছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা।
বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়েছে রথযাত্রা উৎসব। ১২ জুলাই উল্টো রথযাত্রার মধ্য দিয়ে উৎসব শেষ হবে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, জগন্নাথ হলেন জগতের ঈশ্বর। জগৎ হচ্ছে বিশ্ব আর নাথ হচ্ছেন ঈশ্বর। জগন্নাথ হচ্ছেন জগতের ঈশ্বর। জগন্নাথের অনুগ্রহ পেলে মানুষের মুক্তিলাভ হয়।
এ বিশ্বাস থেকেই রথের উপর জগন্নাথ দেবের প্রতিমূর্তি রেখে রথ নিয়ে যাত্রা করেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। তাই দুশো বছর পেরিয়ে আজও সমান জনপ্রিয় চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় রথযাত্রা উৎসব। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে স্থানীয় মানুষের ভিড় এবং উৎসাহ ছিল চোখে পড়ার মতো।
চট্টগ্রাম শহরে ১৮ শতকে শুরু হয় রথযাত্রা উৎসব। নগরের নন্দনকাননে পাহাড়ের চূড়ায় স্থাপিত তুলসীধামে মদনমোহন নরসিংহ গোপাল জীউর মন্দিরে জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার নিয়মিত পূজার্চনা হয়।
১৮ শতকে এই রথযাত্রার সূচনা করেন তুলসীধামের তৎকালীন মোহন্ত শিবকল্পতরু শ্রীমৎ স্বামী অদ্বৈতানন্দ পুরী মহারাজ। শ্রীমৎ স্বামী অচ্যুতানন্দ পুরী মহারাজ এবং পরবর্তীতে ঋষিপুত্র শ্রীমৎ স্বামী নারায়ণ পুরী মহারাজ সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন। কালক্রমে এটি চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় রথযাত্রার রূপ নিয়েছে। এখন চট্টগ্রাম নগরের পাশাপাশি রথযাত্রায় যোগ দেয় শহরের বিভিন্ন মঠ-মন্দির ছাড়াও আশপাশের উপজেলার রথগুলিও।
রথযাত্রা উপলক্ষে তুলসীধামে দিনব্যাপী আয়োজন করা হয় নানারকম ধর্মীয় অনুষ্ঠান। নামকীর্তন, অঞ্জলি, প্রার্থনা ও ভোগবিতরণ। দিনব্যাপী বিতরণ করা হয় মহাপ্রসাদ। এ উৎসবে যোগ দেয় লাখ মানুষ।
পাশাপাশি আলাদাভাবে রথযাত্রা পালন করে ইসকনও। ১৯৯৮ সালে ইসকন প্রথমবার রথ বের করে চট্টগ্রামে। সবমিলিয়ে এবারও রথযাত্রা উপলক্ষে সাজো সাজো রব চট্টগ্রামে।
ইসকন, নন্দনকানন আয়োজিত শ্রীশ্রী জগন্নাথদেবের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কেন্দ্রীয় রথযাত্রা নগরের ডিসি হিলে উদ্বোধন করা হয়। ইসকন প্রবর্তক শ্রীকৃষ্ণ মন্দিরের উদ্যোগেও পৃথক রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বেলুন উড়িয়ে প্রবর্তক মোড়ে রথযাত্রার উদ্বোধন করেন শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল।
ডিসি হিলে রথযাত্রার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনার অনিন্দ্য ব্যানার্জী। অনুষ্ঠানের সূচনা করেন শ্রীমৎ অমিয় বিলাস স্বামী মহারাজ ও শ্রীমৎ ভক্তি নিত্যানন্দ স্বামী মহারাজ। বক্তব্য রাখেন শ্রীমৎ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী। অতিথি ছিলেন প্যানেল মেয়র চৌধুরী হাসান মাহমুদ হাসনী, হাসিনা মহিউদ্দিনসহ জন্মাষ্টমী ও পূজা পরিষদের নেতারা।
রথের পুকুর পাড়ে কেন্দ্রীয় রথযাত্রার অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সিএমপি কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমান। তুলসীধামের মোহন্ত শ্রীমৎ দেবদীপ পুরী মহারাজের পৌরহিত্যে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন রথযাত্রা উদযাপন কমিটির সভাপতি হরিশংকর ধর।
বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত নগরের প্রবর্তক মোড়ে ভিড় জমায় রথযাত্রীরা। নগরের পাঁচলাইশ থানা মোড় থেকে প্রবর্তকগামী রাস্তা, মেডিকেল কলেজ মোড় থেকে প্রবর্তকগামী রাস্তা, ২নং গেট থেকে প্রবর্তকগামী রাস্তা, জিইসি মোড় গোলপাহাড়গামী রাস্তা, পুনাক ক্রসিং থেকে গোলপাহাড়গামী রাস্তা, ওয়াসা থেকে আলমাসগামী রাস্তা, চিটাগাং গ্রামার স্কুল থেকে চট্টেশ্বরীগামী রাস্তা, রেডিসন ব্লু কাজীর দেউড়িগামী রাস্তা, গণি বেকারি থেকে জামালখানগামী রাস্তা, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় নেভাল এভিনিউ মোড়গামী রাস্তা, এনায়েত বাজার বৌদ্ধমন্দির মোড়গামী রাস্তা, এনায়েত বাজার কাজীর দেউড়িগামী রাস্তা, তিন পুলের মাথা রাইফেল ক্লাবগামী রাস্তা, শাহ আমানত মার্কেট থেকে রাইফেল ক্লাবগামী রাস্তা, গণি বেকারি থেকে জামালখানগামী রাস্তা, আন্দরকিল্লা থেকে চেরাগী পাহাড় মোড়গামী রাস্তা, আন্দরকিল্লা থেকে কোতোয়ালিগামী রাস্তা, কোতোয়ালি থেকে আন্দরকিল্লাগামী রাস্তা, নিউমার্কেট থেকে কোতোয়ালিগামী রাস্তা ও কোতোয়ালি থেকে নিউমার্কেটগামী রাস্তাসহ গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে ভিড় ছিল।
নগরের প্রবর্তক মোড় থেকে বিকেল ৫টার দিকে রথযাত্রা শুরু হয়ে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে নগরের নন্দনকানন মোড়ে এসে শেষ হয়। আগামী ১২ জুলাই উল্টো রথযাত্রার মধ্য দিয়ে এ আয়োজন শেষ হবে।